ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কি কারণে জাপানে করোনায় মৃত্যুর হার এত কম ?

প্রকাশিত: ১২:৪০, ৬ জুলাই ২০২০

কি কারণে জাপানে করোনায় মৃত্যুর হার এত কম ?

অনলাইন ডেস্ক ॥ জাপানে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এ নিয়ে এখন নানা তত্ত্ব আলোচনায় উঠে আসছে। কেউ বলছে এর পেছনে রয়েছে জাপানিদের মনমানসিকতা, তাদের সংস্কৃতি। কারো মতে জাপানিদের ইমিউনিটির কারণে করোনায় মৃত্যুর হার কম। তবে করোনায় মৃত্যু জাপানেই যে সর্বনিম্ন তা নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং ও ভিয়েতনামেরও করোনায় মৃতের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু শুরুর দিকে জাপানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ওই সময়ে সার্বিকভাবে গড় মৃতের হারের চেয়ে কম। এপ্রিলে করোনায় টোকিওতে গড় মৃত্যুর হার ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় এক হাজার বেশি। জাপানে এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ৫২২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার রোগী সুস্থ হয়েছে উঠেছে। আর এতে মৃত্যু হয়েছে ৯৭৭ জনের। করোনায় মৃত্যুর হার বাড়ার অনেকগুলো সম্ভাবনা জাপানের ক্ষেত্রে রয়েছে। অথচ জাপান কিন্তু তার প্রতিবেশি দেশগুলোর মতো সর্বশক্তি দিয়ে এ ভাইরাস মোকাবিলায় নামেনি। ফেব্রুয়ারিতে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন তুঙ্গে, যখন শহরটির হাসপাতালে রোগীর ভিড়ে উপচে পড়েছে, যখন চীন থেকে ভ্রমণের ব্যাপারে সারা বিশ্ব দেয়াল তুলে দিয়েছে, তখন জাপান তার সীমান্ত বন্ধ করেনি। ভাইরাস যখন দ্রুত ছড়াচ্ছে, তখন অল্প দিনের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, করোনায় মূলত বয়স্করা মারা যাচ্ছে। জনসমাগম থেকে এই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এবং আক্রান্তের কাছাকাছি আসলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। জাপানের ক্ষেত্রে এর সবগুলো রয়েছে, অর্থাৎ মাথাপিছু বয়স্ক মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর যেকোন দেশের চেয়ে জাপানে বেশি। দেশটির বড় বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যা অনেক, শহরগুলো মানুষের ভিড়ে ঠাসা। টোকিওতে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ বাস করে এবং বেশিরভাগ মানুষের জন্য চলাচলের একমাত্র বাহন ভিড়ে ঠাসা শহরের ট্রেন পরিষেবা। জাপান, এমনকি সেসময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ- টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট' উপেক্ষা করেছে। এখনও জাপানে পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৪৮ হাজার মানুষকে, যা দেশটির জনসংখ্যার ০.২৭ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলোতে যে মাত্রায় লকডাউন দেয়া হয়েছে, জাপানে সেভাবে কোনো লকডাউন হয়নি। শুধু এপ্রিলের প্রথম দিকে জাপান সরকার একবার জরুরি অবস্থা জারি করেছিল। ঘরের ভেতর থাকার জন্য কোনো বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি হয়নি । শুধু অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং সেটা ছিল মানুষের স্বেচ্ছানির্ভর। জরুরি নয় এমন দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তা না মানলে কোনো আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। তাহলে অন্যান্য অনেক দেশের মতো সীমান্ত বন্ধ না করে, কঠোর লকডাউন না দিয়ে, ব্যাপক হারে পরীক্ষা না চালিয়ে আর কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ না দিয়েও জাপান কীভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম রাখতে পারল? জাপানে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ার ৫ মাস পরও দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা ৩০ জুনের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০ হাজারের নিচে, আর মৃতের সংখ্যা ১ হাজারের কম। জাপানে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের ওপর চালানো টেস্টিং এবং টোকিওতে সরকার এ পর্যন্ত যেসব মানুষকে অপরিকল্পিতভাবে পরীক্ষা করেছে, সেসব পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, খুব কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে এই জীবাণু রয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত মাসের শেষের দিকে যখন জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার কথা ঘোষণা করেন, তখন তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে এটাকে 'জাপান মডেল' হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, অন্য দেশের জাপান থেকে শেখা উচিত। জাপানের উপ প্রধানমন্ত্রী তারো আসো বলেন, জাপানের সাফল্যের কারণ নিয়ে অন্য দেশের নেতারা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। তার উত্তরকে অনেকেই অবশ্য কিছুটা তির্যক মনে করেন। তিনি বলেছিলেন, আপনার এবং আমার দেশের মানুষের আচরণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তারা শুনে চুপ করে গিয়েছিলেন। আসো যে শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন সেটা হলো ‘মিন্ডো’। তিনি বলেছিলেন, তফাৎটা ‘মিন্ডোতে’। মিন্ডোর আক্ষরিক অর্থ ‘মানুষের মান’। যদিও অনেকে বলছেন, আসো সংস্কৃতিগত মানের কথা বলেছেন। ঐতিহাসিকভাবে জাপানিরা মনে করে জাতি হিসেবে তারা উঁচুতে এবং সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের বিষয়টাও তাদের মজ্জাগত। তবে মন্তব্যের জন্য আসো সমালোচিত হয়েছেন। তার মন্তব্যের বিষয়টি বাদ দিলেও জাপানের বহু মানুষ এবং অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন, জাপানের ক্ষেত্রে একটা কিছু আছে যা আলাদা। একটা কিছু যা করোনা থেকে জাপানের মানুষকে রক্ষা করেছে। টোকিও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাতসুহিকো কোদামা জাপানের রোগীদের ওপর এই ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। তার ধারণা, জাপানে হয়তো আগে থেকেই করোনা রয়েছে। করোনা নয়, তবে একই ধরনের জীবাণুর অতীত সংক্রমণ জাপানের মানুষকে ঐতিহাসিক ইমিউনিটি দিয়েছে। তার মতে, মানুষের শরীরে যখন কোনো ভাইরাস ঢোকে তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ওই অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। অ্যান্টিবডি দুই ধরনের; আইজিএম ও আইজিজি। আক্রমণকারী ভাইরাস নতুন না পুরনো তার ওপর নির্ভর করে কোন ধরনের অ্যান্টিবডি সেক্ষেত্রে কাজ করবে। তিনি বলেন, কোনো ভাইরাস যদি প্রথমবার আক্রমণ করে তখন প্রথমে আইজিএম অ্যান্টিবডি সক্রিয় হয়ে ওঠে।পরবর্তীতে সক্রিয় হয় আইজিজি। আর কেউ যদি এমন ভাইরাসের শিকার হয়, যে ভাইরাস শরীরে আগেও আক্রমণ করেছিল, তখন সেক্ষেত্রে ইমিউন ব্যবস্থা পরিচিত ভাইরাসের মোকাবিলায় দ্রুত সক্রিয় হয়ে আইজিজি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে। তাতসুহিকো কোদামা বলেন, পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমরা খুবই অবাক হয়েছি। যেসব রোগীর ক্ষেত্রে প্রথমেই আইজিজি অ্যান্টিবডি দ্রুত সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে, এরপর আইজিএম অ্যান্টিবডিও সক্রিয় হয়েছে কিন্তু সেটা পাওয়া গেছে খুবই সামান্য পরিমাণে। এর মানে হলো, আগে একইধ রনের ভাইরাস তাদের সবার শরীরে ঢুকেছিল। তবে তার এই তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন অন্য বিশেষজ্ঞরা। লন্ডনে কিংস কলেজের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরিচালক এবং ব্রিটিশ সরকারের একজন সাবেক সিনিয়র উপদেষ্টা অধ্যাপক কেঞ্জি শিবুয়া বলেন, কোনো একটা অঞ্চলের মানুষের ইমিউনিটি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকতে পারে, জিনগত কারণেও কারো কারো ইমিউনিটি বেশি থাকতে পারে, কিন্তু জাপানীদের ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ কোন জিন আছে এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। তার মতে, যেসব দেশ করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বেশি সফল হয়েছে, তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে সামাজিক ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণ নাটকীয়ভাবে কমাতে পারা। ১৯১৯ সালের ফ্লু মহামারির পর থেকে জাপানের মানুষ একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফেস মাস্ক পরা শুরু করেছে। তারা একশ বছরের এই অভ্যাস এখনও ছাড়েনি। জাপানে কারও কাশি হলে বা ঠাণ্ডা লাগলে, সে অন্যদের সুরক্ষিত করতে সবসময় মাস্ক পরে। হংকং ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ পাবলিক হেলথের পরিচালক এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ কেইজি ফুকুদা বলেন, মাস্ক সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটা শারীরিক প্রতিবন্ধক বলে আমি মনে করি। এটা সংক্রামক ভাইরাস সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন রাখার একটা খুবই ভাল হাতিয়ার। জাপানের ট্র্যাক এবং ট্রেস ব্যবস্থা, অর্থাৎ সংক্রমিত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তার সংস্পর্শে কারা এসেছে সেটা নজরে রাখার ব্যবস্থাও বহু পুরনো। ১৯৫০ দশকে জাপান যখন যক্ষ্মা রোগের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন তারা এই ব্যবস্থা চালু করে। সরকার নতুন কোনো জীবাণুর সংক্রমণের খবর আসলে আক্রান্তদের চিহ্নিত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছিল। তাদের কাজ যেকোনো নতুন সংক্রমণের খবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো। করোনা মহামারির বেশ শুরুর দিকে জাপান দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করেছিল। তারা দেখেছিল একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা একই ধরনের জায়গায় যায়। কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষক ড. কাজুয়াকি জিন্দাই বলেন, আমরা দেখেছিলাম বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষ গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখানে জোরে জোরে গান গাওয়া হয়। আমরা এ ধরনের জায়গায় যেতে নিষেধ করি। কাজুয়াকির সহকর্মীরা দেখেন, কারাওকে ধাঁচের গানের জলসা, পার্টি বা ক্লাবে আনন্দ-উল্লাস, পানশালায় গালগল্প এবং জিমে ব্যায়াম, যেখানে মানুষ পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে, মেলামেশা করে এবং জোরে কথা বলে, জোরে নিঃশ্বাস নেয়, সেসব জায়গায় ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি খুব বেশি। দ্বিতীয়ত তারা দেখে, যারা আক্রান্ত তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। সার্স কোভি-২ সংক্রমণের সময় গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভাইরাস ছড়ায় না, তাদের মাত্র ২০ শতাংশ খুবই সংক্রামক হয়। এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকার জাতীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালায় এবং তিনটা জিনিস এড়িয়ে চলতে বলে। সেগুলো হলো- বদ্ধ জায়গা যেখানে বাতাস চলাচল কম হয়, ভিড় এড়িয়ে চলা এবং খোলা নয় এমন জায়গায় মুখোমুখি বসে গল্প না করা। মানুষকে সতর্ক হয়েছে, সংক্রমণ এড়িয়েছে এবং সংক্রমণ কম হওয়ার কারণে মৃত্যুও কম হয়েছে। যদিও মার্চের মাঝামাঝি টোকিওতে হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়ার ঘটনা ঘটেছিল। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৭ এপ্রিল জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তবে ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক করেননি তিনি। শুধু বলেছিলেন, সম্ভব হলে ঘর থেকে বেরবেন না। জাপান পৃথিবীর আর পাঁচটা দেশের মতোই। রোগ বিস্তারের যে চেইন সেটাকে ভাঙতে পারার মধ্যেই রয়েছে এই রোগ ঠেকানোয় সাফল্যের চাবিকাঠি। জাপানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো, সেখানকার মানুষের মধ্যে নির্দেশ মানার সংস্কৃতি। সরকার জানে তারা জনগণকে কিছু বললে জনগণ তা শুনবে এবং মানবে। জাপানের সরকার মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়নি, থাকা ভালো বলে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু জনগণ ঘরে থেকেছে। অধ্যাপক শিবুয়া বলেন, এটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। জাপানে মানুষকে ঘরে থাকতে বলাটা প্রকৃত লকডাউনের চেহারা নিয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ জারি না করেই সরকার জনগণের সহযোগিতা পেয়েছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×