ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জে কর্মসংস্থান ॥ করোনায় ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ৬ জুলাই ২০২০

চ্যালেঞ্জে কর্মসংস্থান ॥ করোনায় ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির

এম শাহজাহান ॥ প্রাণঘাতী করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের কর্মসংস্থান। কর্মহীন বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দরিদ্র মানুষ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির প্রতিবেদন উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট ঘোষণায় বলেছেন, শুধু করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছে ১৪ লাখ মানুষ। তিনি বলেন, ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি, কলকারখানা বন্ধ থাকা এবং সর্বোপরি ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে তিনি অবশ্য দ্রুত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতি সঞ্চারের মাধ্যমে কর্মহীনতা দূর করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। করোনায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানে উৎপাদনশীল খাত চালু করা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ। এসব কর্মহীন মানুষকে দ্রুত কাজে ফিরিয়ে আনতে উৎপাদনমুখী বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের জন্য ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রামীণ আত্মকর্মসংস্থানে চলতি বাজেটে পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানের দিকে নজর রাখছে সরকার। একই সঙ্গে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতনভাতা প্রদানের লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার এবং কুটির শিল্পসহ এসএমই প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার দুটি আলাদা স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঋণ সুবিধা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত ইডিএফ-এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা এবং ঋণের সুদের হার কমানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রিশিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করা হয়। এছাড়া কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন এবং সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রভৃতি খাতে গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবকদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। এ কাজে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকার এ লক্ষ্যে ৫০০ কোটি টাকা করে মূলধন প্রদান করবে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের আওতায় উপযুক্ত উদ্যোক্তাদের নিকট স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করবে। এসবের পাশাপাশি শিল্প খাতে কর্মসৃজনের গতি বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ আধুনিকায়ন, শ্রমিকের সুরক্ষা জোরদার করা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। যেমন- প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে ২০২৪ সালের মধ্যে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। দক্ষতা উন্নয়ন ॥ দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ও মজুরি বাড়ানো সম্ভব হয় বিধায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্কিল ফর ইমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার আওতায় এ যাবত ৪ লাখ ২৮ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে, যার অধীনে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২৮ উপজেলার মাধ্যমে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৭ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও ২ লাখ ২৭ হাজার ৪০২ জনের অস্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে সমন্বিত আকারে পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে এবং এটিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিধিমালা, প্রশিক্ষিণ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নীতিমালা ও জাতীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এবং এর জনবল কাঠামো অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হিসেবে তৎকালীন ১৯টি থানায় পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম শুরু করেন। এ কার্যক্রমের সফলতার কারণে বর্তমানে দেশের সকল জেলায় প্রত্যেক উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আশা করা যায়, এ প্রণোদনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। করোনাজনিত আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করা এবং গ্রামে বসবাসরত দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা করছি। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ॥ বর্তমানে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে এক কোটি বিশ লাখের বেশি অভিবাসী কর্মী কর্মরত রয়েছেন। বিগত দশ বছরে পেশাজীবী, দক্ষ ও আধা দক্ষ এবং স্বল্প দক্ষ ক্যাটাগরিতে সর্বমোট ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের অধিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান রয়েছে যা এ পর্যন্ত মোট কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৭ লাখের বেশি জনের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। নারী কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টার কারণে এ সরকারের বিগত দশ বছরে মোট ৭ লাখ ৭৮ হাজারের অধিক নারী কর্মী বিভিন্ন পেশায় চাকরি নিয়ে বিদেশ গমন করেছেন। কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা সংস্থাগুলো যা বলছে ॥ করোনা সঙ্কট থেকে উত্তরণে দ্রুত বেশির ভাগ মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশ চলমান জনসংখ্যার বোনাসকালের সুফল ভোগ করতে পারবে না বলে উঠে এসেছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কৌশলপত্রের খসড়ায়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ‘ন্যাশনাল জবস স্ট্র্যাটেজি ফর বাংলাদেশ’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বেকারত্ব দূর করতে হলে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছর পাঁচ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি দেশে ১৮ লাখ ৪০ হাজার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও (বিডা) নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিপরীতে ২০১১-১২ অর্থবছরের পর থেকে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশী-বিদেশী নিবন্ধিত কোম্পানিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬২ জনের। পরের অর্থবছর সামান্য কমে নামে ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৫০ জনে। গত ২০১৪-১৫ সময়ে তা আরও কমে নামে ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৩ জনে। পরের অর্থবছর কর্মসংস্থান হয় ২ লাখ ২৬ হাজার ৪১১ জন। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯২ জন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ২০১৯ সালে বিজিএমইএর আওতাধীন ৬৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে ৩২ হাজার ৫৮২ জন শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। বিজিএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির জানিয়েছেন, গত দুই বছরে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে গার্মেন্ট সেক্টরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১৮ শতাংশ। গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০ লাখ শ্রমিক বেকার হবে। সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান কমবে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, চামড়াসহ উৎপাদনমুখী খাতে। বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ড. কাজী খলীকুজ্জামন আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা সঙ্কটের কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। কিন্তু এরপরও কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বেকারত্বের হার নব্বইয়ের দশক থেকে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষ কর্মীর বিপরীতে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার তথ্য স্বীকার করে শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় তৈরি পোশাক খাতসহ শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। আগে যে পরিমাণ সুতা উৎপাদন করতে আড়াই হাজার শ্রমিক লাগত, এখন সেখানে লাগছে মাত্র ৬০০ শ্রমিক। প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন উৎপাদনের অনেক প্রক্রিয়াই কমে গেছে, তাই শিল্পের উৎপাদন, রফতানি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না, উল্টো কমছে। তিনি বলেন, পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে নজর দেয়া প্রয়োজন।
×