ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মামুন আঃ কাইউম

শুভ জন্মদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২১:৩১, ৬ জুলাই ২০২০

শুভ জন্মদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে মতিহারের সবুজ চত্বরে অবস্থিত ছায়া সুনিবিড় একটি ক্যাম্পাস। ভেতরের প্যারিস রোডের গাছগুলোর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই এটি দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বুকে। ঠিক যেমনিভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বুকে। নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালী জাতির অনেক আশা- আকাক্সক্ষা আর ঐতিহ্য। দেশের উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে এর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। ১৯৪৭ সালে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। পরিক্রমায় ১৯৫০ সালে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো শহরের ভুবন মোহন পার্কে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর আন্দোলনের পর পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য আইনজীবী মাদারবখশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে প্রথম উপাচার্য করে প্রথম ক্লাস শুরু হয় আরেক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে। সাতটি বিভাগে মাত্র একশ’ একষট্টি শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৬১ সালে অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানিটমাসের পরিকল্পনায় মতিহারের সবুজ চত্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্থায়ী নিজস্ব ক্যাম্পাস। প্রতিষ্ঠার পর প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ায় বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাড়াও ত্রিশ ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারী শহীদ হন। ১৯৫৩ সালে শুরু হওয়া সাতটি বিভাগের একশ’ একষট্টি ছাত্রের স্থলে এখন এর বিভাগ ৫৯টি এবং শিক্ষার্থী প্রায় চল্লিশ হাজার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১২৫০ আর কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় ২৬০০। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আলোকে বিশ্বের উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালগুলোর সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়ন যেমন চলছে, ঠিক তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতাধিক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ৬৭ বছরে জড়িত ছিলেন দেশবরেণ্য অনেক ব্যক্তি। এখানে শিক্ষকতা করেছেন জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. এনামুল হক, বিজ্ঞানী পিটার বার্টচি, প্রফেসর ড. এমএ বারী, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, প্রফেসর হাসান আজিজুল হক, প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা, প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক, প্রফেসর বদরুদ্দিন উমরের মতো সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ। আবার এখানকার রাকসু বা ছাত্ররাজনীতির অনেক দিকপাল এখন দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন পদে সুনামের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন ও করছেন। ২০১৯ সালে বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তিতে সিমাগো-স্কপাসের জরিপে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম অবস্থান দখল করেছিল। আর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট এখন দেশ ও বিদেশের মাটিতে নিজের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানকে কর্ম ও নিষ্ঠার সঙ্গে আলোকিত করছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহশিক্ষা কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ্যালামনাইরাও তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে জ্যোতি ছড়াচ্ছেন। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এসব যেমন বর্তমান শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়, তেমনি কিছু বিষয় আবার সামনে চলার পথে প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করতে পারে। বর্তমান সরকার আধুনিক ক্যাম্পাস নির্মাণে তিনশ’ চৌষট্টি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বমানের করতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রায়ই পাওয়া যায় না। দেশে নগরকেন্দ্রিক বিবেচনায় প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেশের দায়িত্বশীল অনেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়কে তেমন মূল্যায়ন করতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনাময় এ্যালামনাইদের বৃহৎ প্ল্যাটফর্মে এক সঙ্গে না করতে পারাটাও সাময়িকভাবে চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হয়। বিগত সময়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দেয়া ৬৭ বছরের এ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণ করে আরও সামনে এগিয়ে যাবে। আলোকিত করবে দেশ ও জাতিকে- রইল সেই প্রত্যাশা ও শুভ কামনা। দ্রুতই করোনা শেষে মতিহারের সবুজ চত্বর আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে, সেটি আমাদের বিশ্বাস। শুভ জন্মদিন প্রাণের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×