ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এমএ হানিফ

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে কালো টাকার মালিক!

প্রকাশিত: ২১:১০, ৬ জুলাই ২০২০

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে কালো টাকার মালিক!

ফেসবুকে এক যুবককে মারতে দেখে বাড়ির ছোট ছেলে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা ছেলেটাকে ওরা মারছে কেন? মা জবাব দিল, ছেলেটা চোর। ছেলে বললো, কী চুরি করেছে? মা বলল, যাই চুরি করুক, মাইর-ই চোরের উপযুক্ত শাস্তি। তাই বলে এভাবে মারবে? পাবলিক যখন মারে, তখন এই ভাবেই মারে। ছেলেটা ভিডিও দেখা বন্ধ করে মায়ের কোলে শুয়ে পড়ল। মা ছেলেকে বুঝিয়ে বলল, চুরি করা একটা অন্যায় কাজ। ধর্মমতে চোরের শাস্তি তার হাত কেটে দেয়া। আমাদের সমাজে হাত কাটে না, চোর ধরে পাবলিক গণধোলাই দেয়। গণধোলাই দেয় কেন? আমাদের দেশে কি আইন নাই? আইন আছে। কিন্তু আইনের ওপর জনগণের আস্থা কম। চোরকে মেরে তারাও তো অন্যায় করল, করল না? মা উত্তর দিল না। ছেলে আবার বলল, মা শোন, চোর চুরি করে অপরাধ করেছে। আর পাবলিক অপরাধ করেছে তাকে মেরে। প্রকৃত পক্ষে দু’পক্ষই অপরাধী। মা বলল, চোরের চুরি করাটা অপরাধ, মাইর দেয়া অপরাধ নয়। এটা চুরির শাস্তি। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা এ রকম। কারও অপরাধ ধরা পড়লে আমরা সবাই মিলে আইনের রক্ষক হয়ে যাই। আইন রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা যে আরেকটা অপরাধ করে বসি, সেটাকে আমাদের অপরাধ বলে মনে হয় না। গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। যার আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম বাজেট ছিল ৯৯৫ কোটি টাকা। দেশ আর আগের অবস্থানে নেই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যদি দুর্নীতির কালো গ্রাস সীমিত রাখা যেত হয়ত, এর চেয়েও অনেক এগিয়ে যেত দেশ। এবারের বাজেটে সবার নজর ছিল স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, কোভিট-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে জরুরী এবং অপ্রত্যাশিত আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মেটাতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে মূলত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। জরুরী চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাবও করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে বরাদ্দ বাড়লেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার ব্যবহার কতটা করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক সূচকে দেশ উন্নতি করলেও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে কতটা নাজুক, তা করোনা এসে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তাই স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি এখন সময়ের দাবি। দুর্নীতি বন্ধ করে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করলেই কেবল জনগণ এর সুফল পাবে। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর জানিয়েছেন ব্যাংক থেকে এই ঋণ গ্রহণ করলে ব্যাংকিং খাতে তেমন প্রভাব পড়বে না। সুতরাং এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। এটা অর্জন করা সম্ভব কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, করোনা মহামারীর এই সময়টা আরও কতদিন দীর্ঘ হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। মহামারী যদি আরো কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে তাহলে সত্যিকার অর্থেই প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা দুঃসাধ্য হবে। তবে লক্ষ্য বড় থাকা ভাল। পুরোটা অর্জন না হলেও যদি কাছাকাছি অর্জিত হয়, সেটাই হবে করোনাকালের এ মহামারীতে একটা বড় প্রাপ্তি। যে প্রসঙ্গে শুরুর গল্পটি বলা এখন সে কথায় আসি। বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যার প্রায় সিংহ ভাগ আসবে রাজস্ব খাত থেকে। এসব জনগণের করের টাকা। জনগণ কর দিচ্ছে। কর দেয়ায় সচেতনতা বেড়েছে। সরকারের নানা মুখী উদ্যোগ ও কর্মকা- কর দেয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে। যার বদৌলতে গতবছর রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা যথাসময়ে কর দিচ্ছে তারা ২৫% হারে দিচ্ছে। আর কালো টাকার মালিকেরা যারা দেশের ক্ষতি করে বিদেশে অর্থ পাচার করছে, অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, তাদের অপ্রদর্শিত ও অবৈধ অর্থ সাদা করার জন্য ১০% হার! এটা অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত করার মতই নয় কি? এই ধরনের ছাড় বা পুরস্কার ওই সব অর্থ লোভীদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়তে যে নতুন করে উৎসাহিত করবে না, এমন কথা কি আমরা জোর গলায় বলতে পারি? রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগের নানা সূত্র থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, এ পর্যন্ত দেশে ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। ওই দুই অর্থ বছরে প্রায় ৩২ হাজার ব্যক্তি ওই সুযোগ নিয়ে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বৈধ করেছিল। আর এ যাবতকাল মোট সাদা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং তার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এ ছাড়াও টিআইবির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে। তখন ১ হাজার ৯২৩ জন ব্যক্তি প্রায় এক হাজার ২১৩ কোটি টাকা সাদা করেছিল। কালো টাকার মালিকদের কারণেই দেশ থেকে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো পাচার হয় বলে ধারণা করেন গবেষকরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলেছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। (বিবিসি বাংলা-১২ জুন, ২০২০) প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কালো টাকার মালিকদের আইনের আওতায় না এনে বার বার কেন সুযোগ দেয়া হচ্ছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনা যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলছেন, তখন এই সব দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপোস করেই কেন প্রতি বছর বাজেট উপস্থাপিত হয়? তাহলে কি তারা এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেয়েও বেশি শক্তিশালী? তারা কি আইনের উর্ধে? এসব দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্র আর কত ছাড় দেবে? যারা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, যারা কর ফাঁকি দিচ্ছে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছে তাদের প্রতি বছর এমন সুযোগ না দিয়ে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। জনসমক্ষে তাদের নাম প্রকাশ করা দরকার। সামাজিকভাবে হেয় করা উচিত। তাদের সঙ্গে আপোস করার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রের বেরিয়ে আসতে হবে। আইন সকলের জন্য সমান- এই কথাটি শুধু কথার কথা না হয়ে বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সামান্য কিছু চুরি করলে যে রাষ্ট্রে পাবলিক ধরে গণধোলাই দেয়, সেই একই রাষ্ট্রে বড় বড় চোরদের বার বার পুরস্কৃত করা জাতির সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা নয় কি? এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। নইলে বঙ্গবন্ধুর বৈষম্য মুক্ত সোনার বাংলা অধরাই থেকে যাবে। লেখক : কথাসাহিত্যিক [email protected]
×