ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল যুগের পেশা

প্রকাশিত: ২১:০৯, ৬ জুলাই ২০২০

ডিজিটাল যুগের পেশা

(এই কলামে আমি ডিজিটাল যুগের দক্ষতার সাতকাহন লিখছি। এর আগে তিনটি প্রকাশিত হয়েছে। আরও দুটি পরে প্রকাশিত হবে। সামনের দুই সপ্তাহেও চোখ রাখুন এই কলামে) খুব সঙ্গত কারণেই আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারি যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ প্রত্যয়নপত্র নিয়েও ডিজিটাল যুগের দক্ষতা অর্জন করা যায়না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় কয়েকটি দুর্বলতা হলো ক) পাঠক্রম যুুগোপযোগী নয় খ) পাঠক্রমের বাইরের কোন শিক্ষা ছাত্রছাত্রীরা পায়না। গ) পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাল শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এমনকি কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরাও পরিপূর্ণ বা যথাযথভাবে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল দক্ষতা বা ডিজিটাল জ্ঞান হয়ত অর্জন করে না। তাদের নজরও পাঠ্য বিষয় বা পাঠ্য বইতে সীমিত থাকে। পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সূত্র ধরে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসা দরকার ছিল সেটি যথাসময়ে যথাযথভাবে না আসার ফলে সার্টিফিকেট হাতে চাকরির আবেদনপত্র নিয়ে ঘোরার মানুষের সংখ্যা শিক্ষার হারের পাশাপাশি জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। স্বয়ংক্রিয়তার পথে : বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম একটি প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার আগামী সময়টাতে যান্ত্রিক স্বয়ংক্রিয়তার একটি চিত্র তুলে ধরেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে ১৮ সালে ঘণ্টা হিসাবে শ্রমের ৭১ ভাগ ছিল মানুষের। অবশিষ্ট ২৯ ভাগ ছিল যন্ত্রের স্বয়ংক্রিয়তার আওতায়। এই প্রতিবেদন অনুসারে ২২ সালে মানুষের শতকরা হিসাবটা নামবে শতকরা ৫৮ ভাগে আর যন্ত্র নিয়ে নেবে শতকরা ৪২ ভাগ। হিসাবের ভারসাম্য পুরোই বদলে যাবে ২০২৫ সাল নাগাদ। তখন মানুষের চেয়ে বেশি শ্রম ঘণ্টা পাওয়া যাবে স্বয়ংক্রিয়তার মাঝে। সেটি হবে শতকরা ৫২ ভাগ। মানুষ কেবল ৪৮ ভাগ অবদান রাখবে। আমাদের কি এখনই এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে না? বিশেষ করে আমাদের মতো কায়িক শ্রমনির্ভর জনগোষ্ঠীর দেশে যদি আমরা সামনের দিনগুলোর কথা না ভাবি তবে সমূহ বিপদে পড়ব। আমার নিজের ভয়টা হচ্ছে যে বিষয়টিতে আমাদের সচেতনতা বাড়ছে না। আমি ডাক বিভাগের কয়েকটি অঞ্চলের ১৯ সালের চাকরির আবেদনের হিসাব দেখে আতঙ্কিত হয়েছি। যেখানে পদের সংখ্যা ১৮৩ সেখানে আবেদনের সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজার। ১৭ সালের ৫ অক্টোবর যশোরে এমনই ভয়াবহ চিত্র দেখেছি। আমি নিজে এই অবস্থাটি জানি বলেই সেই ৮৭ সাল থেকেই শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলে আসছি। এটাও বলে আসছি যে শিক্ষার পরিবর্তনটা ওপরে যেভাবেই করুন শিশু শ্রেণী থেকেই শুরু করতে হবে। এ জন্য ডিজিটাল শিক্ষার শেকড়টা আমি শিশু শ্রেণী থেকেই শুরু করেছি। এই ভাবনা থেকেই আমি শিশুদের প্রোগ্রামার বানানোর লড়াই শুরু করেছি। আসুন আমরা আমাদের শিশুদের জন্য নিজেদের ভবিষ্যতকে উৎসর্গ করি। অবশ্য আমি অবাক হইনি এটি দেখেও যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কেবল কোটা প্রথাকেই তাদের শত্রু মনে করেছে, ওরা ভাবতেই পারেনি যে তাদের কোটার বিষয়টি আদৌ সঙ্কট নয়, বস্তুত মেধাভিত্তিক ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনই মূল লড়াই। এটি হতাশাজনক যে এরা নিজেরা এই দক্ষতা অর্জনে তেমন আগ্রহী নয় এবং যারা তাদের শিক্ষিত করেন তারা নিজেরা জানেন না এদের জন্য কোন্ দক্ষতা প্রদান করা উচিত। কর্মসংস্থান এখন ও আগামী দিনে : বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ১৮ সালের কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিবেদন তুলে ধরছে একেবারেই ভিন্ন চিত্র। সে জন্য বেকারের বিদ্যমান স্রোত ঠেকাতে এদের দক্ষতা তৈরির পরিকল্পিত ও সমন্বিত আয়োজন করতে হবে। ভবিষ্যতে বেকারের স্রোত ঠেকাতে বদলাতে হবে শিক্ষার সবকিছু। উচ্চ শিক্ষার দিকে জরুরী নজর দিতে হবে এ জন্য যে তারা পেশার জন্য তৈরি হওয়ার পথেই রয়েছে। যদি শিক্ষার শেষ ধাপেও কোন দক্ষতা সে না পায় তবে তার হতাশার সূচনা হয়। তবে নজরটা বেশ ভালভাবে দিতে হবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরেও। আমাদের এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে। এই বেকার তৈরির কারখানাগুলো যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অব্যাহত থাকে তবে আগামী দিনগুলোতে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নবীনদের বেকারত্ব ভয়াবহ হতে বাধ্য। এখনই আমাদের ভাবতে হবে যে তখন কি কাজে লাগবে আমার মানবসম্পদ? যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার সেটি হলো এখন আমরা যদি এটি ভাবি যে, ছেলেমেয়েদের কেবল কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেব বা এদেরকে কম্পিউটার শেখাব তবেও হিসাবটাতে বড় ভুল হবে। এখন সময়টা প্রচলিত কম্পিউটার যুগের নয়। এটি এমনকি কেবল ডাটার যুগও নয়। কোন সন্দেহ নাই যে ডিজিটাল সংযুক্তি আমাদের বহমান সভ্যতার মহাসড়ক। বস্তুত সামনের দিনের সকল কর্মকান্ড ডিজিটাল সংযুক্তিকে ঘিরেই ঘটবে। বিশেষ করে ৫জির মতো দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড তারহীন ইন্টারনেট দুনিয়ার ব্যক্তিগত জীবন থেকে, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কল কারখানা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন অবধি সবই বদলে দিতে আসছে। উপলব্ধি করতে কষ্ট হতে পারে যে এখন যাদেরকে আমরা স্কুলে প্রবেশ করাচ্ছি তারাই বা কোন্ সময়কালে কর্মজীবনে বসবাস করবে। সেই সব ভাবলে আমাদের এখন শিশুদের প্রোগ্রামার বানাতে হবে এবং তাদের হতে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে তাদের হতে হবে সৃজনশীল মানবগোষ্ঠী যারা উদ্ভাবন ও গবেষণায় মনোযোগী হবে। অপ্রিয় সত্য হলো আমাদের যাত্রা এখনও সেই পথে নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ভবিষ্যতের চাকরি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, It is clear from our data that while forecasts vary by industry and region, momentous change is underway and that, ultimately, it is our actions today that will determine whether that change mainly results in massive displacement of workers or the emergence of nwe opportunities. Without urgent and targeted action today to manage the near-term transition and build a workforce with futureproof skills, governments will have to cope with ever-growing unemployment and inequality, and businesses with a shrinking consumer base. Our dataset aims to bring specificity to the debate and to the options for action, by providing the perspective of Chief Human Resources Officers of leading employers who are among those at the frontline of the emerging trends and are key actors in implementing future workforce strategies. (http://reports.weforum.org/future-of-jobs-2016/employment-trends/) বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভবিষ্যতের চাকরি প্রতিবেদন ২০১৮ এর প্রধান বক্তব্যটি হলো : সহসাই স্বয়ংক্রিয়তার ফলে বহু চাকরি বিলুপ্ত হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে যারা রুটিন মাফিক, মাঝারি দক্ষতা- যেমন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, সাদা কলারে চাকরি, হিসাবরক্ষক, এ্যাকাউন্টিং, পেরোল, একান্ত সচিব, অডিটর, ব্যাঙ্ক টেলার বা হিসাবরক্ষকের চাকরি করছেন তারা বিপন্ন হতে পারেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি এসব কাজকে যান্ত্রিক করে দিতে পারে। Despite the high number of jobs that could be displaced, a higher number of jobs could be created through advanced technology, while jobs that require human interaction are less likely to be taken over by robots. তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে ১৮ সালের প্রতিবেদনে আশার কথাও আছে। প্রতিবেদন অনুসারে ডিজিটাল প্রযুক্তি নতুন নতুন পেশার উদ্ভবও ঘটাতে পারে। “In purely quantitative terms, 75 million current job roles may be displaced by the shift in the division of labour between humans, machines and algorithms, while 133 million nwe job roles may emerge at the same time.” এর মানে হলো সড়ে সাত কোটি চাকরি গেলেও ১৩.৩ কোটি নতুন চাকরি আসবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ৫টি প্রধান ক্ষেত্রকে এ জন্য চিহ্নিত করেছে। ক) তথ্য বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানী, খ) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যান্ত্রিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গ) ব্যবস্থাপক, ঘ) সফটওয়্যার ডেভলপার ও ঙ) বিক্রয় ও বিপণন কর্মী। সুখবরটি হলো যে নতুন কর্মসংস্থান যা সৃষ্টি হবে তা হারিয়ে যাওয়ার মতো পেশার চাইতে বেশি হবে। পুরো মানবসভ্যতার জন্য এটি একটি আশাব্যঞ্জক খবর। আমরা যদি নতুন কর্মক্ষেগুলোর দিকে তাকাই বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারি যে এর জন্য নতুন যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেখা যাক নতুন ৫টি ক্ষেত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি কি হতে পারে। ক) তথ্য বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানী (ডাটা এনালিস্ট ও সায়েন্টিস্ট) বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে এই ক্ষেত্রটির বহুমুখী প্রয়োগ রয়েছে। তবে এর প্রধান বিষয় হচ্ছে তথ্য বের করা, বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করা এবং তথ্যের অর্থ উদ্ধার করে তাকে নানাভাবে কাঠামোগত পদ্ধতিতে বিভাজন করা। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হবে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা, এর ভাবধারা, মনোভাব বা প্যাটার্ন শনাক্ত করা। এসব উপাত্ত সংশ্লিষ্ট মহলের প্রয়োজন অনুসারে কাজে লাগানোটাও খুবই জরুরী। খ) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যান্ত্রিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ : যদিও এই পেশাটি একেবারেই নতুন নয় তথাপি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লবকে প্রেক্ষিত বিবেচনায় নেয়ার সময় আমাদের ৫জির কথাও ভাবতে হবে। এই পেশায় যারা অংশ নিতে চান তাদের এই প্রযুক্তির নানাবিধ বহুমুখী প্রয়োগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। বস্তুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ মানে হলো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যমান যন্ত্রকে নতুন প্রযুক্তি প্রদান এবং নতুন প্রযুক্তির নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করা। অন্যদিকে যান্ত্রিক শিখন বিষয়টি হচ্ছে যন্ত্রকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা প্রদান করা। এর সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক সম্পৃক্তি রয়েছে। আমরা যখন চালকবিহীন গাড়ির কথা বলি তখন এই প্রযুক্তির কথা ভাবতে হয়। গ) ব্যবস্থাপক ও কর্ম পরিচালক : সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে ম্যানেজ ও পরিচালনা করার কাজ এটি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয় “General and operations managers as those who Plan, direct, or coordinate the operations of public or private sector organisations. Their duties and responsibilities may include formulating policies, managing daily operations, and planning the use of materials and human resources, but are too diverse and general in nature to be classified in a one functional area of management or administration, such as personnel, purchasing, or administrative services. These are roles that still leverage distinctively human skills. ঘ) সফটওয়্যার ও এ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপার ও বিশ্লেষক : বিশ্ব অর্থনেতিক ফোরাম এই পেশাটির বিবরণ দিয়েছে এভাবে, WEF notes that among the range of roles that are set to experience increasing demand in the period up to 2022 stand software and applications developers. These are roles that are significantly based on and enhanced by the use of technology. Jobs in this field include – professionals responsible for the administration, monitoring and maintenance of software infrastructures and applications. Meanwhile, create the applications that enable us to perform specific tasks on devices like computers, while an makes computers perform specific tasks based on client specifications. ঙ) বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ কর্মী : বিশ্ব অর্থনেতিক ফোরাম এই পেশাটির বিবরণ দিয়েছে এভাবে, The role of a sales and marketing professional requires a human touch. While they appear similar, they each have distinct differences. A sales professional is someone who sells products or services to potential customers, such as individuals or small groups, and requires turning leads and prospects into purchases. Meanwhile, marketing involves communicating the value of a product or service to a larger audience. The process of doing so is typically longer as it requires time to build a brand. ঢাকা, ০৪ জুলাই ২০২০ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক [email protected], www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com
×