ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদুল হাসান

বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ ॥ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটি খাত

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ৫ জুলাই ২০২০

বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ ॥ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটি খাত

প্রাণিসম্পদ প্রাণিজ আমিষ যোগানের একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রাণিজ উৎস থেকে সরবরাহকৃত আমিষের পরিমাণ প্রায় ৬৫ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে এবং ৫০ শতাংশ পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কৃষির উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতা তখন দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন ‘...আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে, যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ, এদিন আমাদের থাকবে না’ ( ভিডিও থেকে ধারণকৃত, ভিডিও সংগ্রাহক- ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, উপ-সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য উৎপাদনে সর্বদাই গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেন ‘... খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকেও বোঝায়। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৭টি ফ্রিজিয়ান ষাঁড় আনয়নের মাধ্যমে গবাদি পশুতে যুগান্তকারী কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি প্রবর্তন করে গবাদি পশুর জাত উন্নয়নে বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন কৃষকদের ভালবাসতেন তাদের ভালবাসাও পেয়েছেন সর্বক্ষণ। জাতির পিতার সূচিত পথ ধরে আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাতেও অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ২২.৮৬ লাখ মেট্রিক টন যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৯৯.২৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাংস উৎপাদন ছিল ১০.৮৪ লাখ মেট্রিক টন যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ৭৫.১৪ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ডিম উৎপাদন ৪৬৯.৬১ কোটি থেকে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ১৭১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন ন্যূনতম ২৫০ মিলিলিটার দুধ, ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে দুধ, মাংস ও ডিমের জনপ্রতি প্রাপ্যতা বেড়ে যথাক্রমে ১৬৫.০৭ মিলি লিটার/ দিন, ১২৪.৯৯ গ্রাম/ দিন, ও ১০৩.৮৯ টি/ বছরে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত দুধ, মাংস ও ডিম জাতীয় চাহিদার ৬৬.০৩%, ১০৪.১৫ % এবং ৯৯.৮৯% যোগান দিয়ে থাকে। অর্থাৎ দেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাছাকাছি। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে যেখানে কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান যা মোকাবেলা করে আমাদের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করোনার ফলে এই সেক্টরের ক্ষতিকেও কাটিয়ে উঠতে হবে। দেশের ডেইরি শিল্প উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ সমূহের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্যের অভাব, খামারির সামর্থ্যরে বিবেচনায় অধিক উৎপাদনশীল গরুর জাত নির্বাচন, সঠিক পরিকল্পনা ও খামার ব্যবস্থাপনা, দুগ্ধ এবং দুগ্ধ পণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণ এবং খামারের বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অন্যতম। প্রাণী খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনেও বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। দানাদার খাদ্য হিসেবে মূলত বিভিন্ন শস্য উপজাত, শস্যদানা ও খৈল ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, করোনা সঙ্কটে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রি, ফিড ইন্ডাস্ট্রি, বাণিজ্যিক পোল্ট্রি (ডিম ও মাংস), প্রসেসড ইন্ডাস্ট্রি, ওষুধ, মিনারেল, প্রিমিক্স ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এক তথ্যে জানা যায়, দেশে উৎপাদিত মাংসের প্রায় ৬০% আসে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া থেকে এবং ৪০% আসে বিভিন্ন পোল্ট্রি প্রজাতি থেকে। দেশে উৎপাদিত ডিমের প্রায় ৫০% আসে বাণিজ্যিকভাবে পালনকৃত মুরগি থেকে এবং বাকি ৫০% আসে দেশী মুরগি ও হাঁস থেকে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন জানান, এবার মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তখন থেকে দুধের প্রত্যাশিত বিক্রি সম্ভব হয়নি। সাধারণত বড় বড় অনুষ্ঠান যেমন মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, মহান বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, ছাত্র-ছাত্রীদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল, বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক বড় বড় অনুষ্ঠানে মিষ্টি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইমরান উদাহরণস্বরূপ বলেন তার নিজস্ব তিনটি মিষ্টির দোকান থেকে এবার এসএসসি ফলাফলের পর মাত্র ৩৫ কেজি মিষ্টি বিক্রি হয়েছে যা এর আগের বছরে ছিল প্রায় ৯০০ কেজি। তিনি আরো জানান দুধ থেকে ঘি, মাখন, পনির, আইসক্রিম ইত্যাদি করার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন কিন্তু তার মতে দুধ পৃথক করে ঘি বানানো বা দুধকে পাউডার দুধে রূপান্তরিত করার জন্য যে প্ল্যান্ট দরকার সেটা আমাদের দেশে খুব একটা বেশি নেই। মিল্ক ভিটা, আড়ং এবং প্রাণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দুধের পাউডার করার জন্য তাদের প্ল্যান্ট রয়েছে কিন্তু স্বাভাবিকভাবে পাউডার করার সক্ষমতা খুবই অল্প। এছাড়া দুধ থেকে ক্রিম পৃথক করে ঘি বানাতে যে মেশিন প্রয়োজন তা তিনি নিজে বিভিন্ন সময়ে ৭৫ হাজার, ৯০ হাজার এমনকি ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন যা প্রান্তিক খামারিদের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় পোল্ট্রি ও ডেইরি সেক্টরের প্রান্তিক খামারিদের অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনি এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসককে খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে দুধ ও ডিম সরবরাহের এবং মিষ্টির দোকান খোলা রাখার পরামর্শ প্রদান করেন। স্থানীয় খামারিরা যারা তাদের দুধ এবং ডিম বিক্রি করতে পারছিলেন না তাদেরকে সহায়তা করার লক্ষ্যে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাগণ দুধ ও ডিম বিক্রয়ের জন্য ভ্রাম্যমাণ বাজার কর্মসূচী চালু করেন। স্থানীয় প্রশাসন তাদের সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। কর্মসূচীর মাধ্যমে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারাদেশে সাধারণ খামারিদের ২৭০০ কোটি টাকার বেশি প্রাণিজ জাতীয় পণ্য বিক্রি হয়েছে বলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুল জব্বার অবহিত করেন। খামারিদের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ বাজার কর্মসূচী উদ্যোগটি ভাল কাজ করছে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব রওনক মাহমুদ নিশ্চিত করেছেন। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার বলেন, ডেইরি উন্নয়ন গবেষণা শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকায় নির্ধারিত ১৩০ জন ক্ষুদ্র ও ছোট আকারের ডেইরি খামারিদের মাঝে দানাদার খাদ্য, ফডার চাষ, উন্নত জাতের সিমেন, কৃত্রিম প্রজনন, ভ্যাকসিন প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রাখার পাশাপাশি খামারিরা যাতে সুলভ মূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারে সে জন্য প্রতিটি কমিউনিটি থেকে একজন করে দুধ বিক্রেতা তৈরি করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন র‌্যাব এর মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন অবহিত করেন, করোনা মহামারীতে দুধ খামারিরা দুধ বিক্রি করতে পারছে না তাই এগুলো যেন পনির এবং ঘি বানানোতে ব্যবহার করা হয় প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের নির্দেশনার আলোকে সিরাজগঞ্জের র‌্যাব ব্যাটালিয়ন দুধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে ১ লাখ লিটার দুধ ক্রয় করে এবং তা দিয়ে ঘি ও পনির প্রস্তুত করে। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থেকে কারিগর নিয়ে পনির বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। সিরাজগঞ্জ র‌্যাব ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম, পিএসসি জানান প্রায় ১০০ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে দুধ ক্রয় করে করোনা দুর্যোগের এই আপৎকালীন তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা হয়। এতে করে দুগ্ধ খামারিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত ও কর্মহীন কারিগরদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এমনভাবে অনেকেই যদি এগিয়ে আসে তাহলে দুধ থেকে পনির অথবা ঘি বানিয়ে দুধের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব। পোল্ট্রি এবং ডেইরি সেক্টরটি সম্ভাবনাময় একটি খাত। কৃষি সেক্টরের পাশাপাশি এই সেক্টরের গুরুত্ব একইভাবে প্রদান করা হলে বিশাল একটা সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হবে। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে আরও বেগবান করার জন্য নি¤েœ বর্ণিত পদক্ষেপসমূহ নেয়া যেতে পারে। ১. দুধ এবং ডিমের জন্য ভ্রাম্যমাণ বাজার কর্মসূচী অব্যাহত রাখা যেতে পারে। প্রতিটি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় শহরে দুধ সংগ্রহ ও বিক্রির জন্য পিক-আপ অথবা তিন চাকার ভ্যানচালক যারা কর্মহীন হয়েছেন তাদের দুধের কন্টেইনার সরবরাহ করে শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন স্থান হতে দুধ সংগ্রহ এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দিষ্ট জায়গায় বিক্রির বা ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ২. পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম উপকরণ একদিনের মুরগির বাচ্চা। বাংলাদেশের নিবন্ধিত প্যারেন্ট স্টক খামার হতে সপ্তাহে ১ কোটি ৭০ লাখ ব্রয়লার এবং ১৩ লাখ লেয়ার একদিনের বাচ্চা উৎপাদিত হয় বলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একটি তথ্য থেকে জানা যায়। প্যারেন্ট স্টক একদিনের বাচ্চার জন্য ১৬টি গ্র্যান্ড প্যারেন্টস স্টক খামার রয়েছে যা থেকে একদিনের প্যারেন্ট স্টক বাচ্চার উৎপাদন খরচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। অথচ বিদেশ থেকে একদিনের প্যারেন্ট স্টক বাচ্চার আমদানি খরচ প্রায় ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে বছরে এক লাখ ১৩ হাজার গ্র্যান্ড প্যারেন্ট বাচ্চা আমদানি করতে হয় যেখানে প্রতিটি বাচ্চার আমদানি মূল্য অনেক বেশি। কাজেই দেশে প্যারেন্ট স্টক সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশীয়ভাবে গ্র্যান্ড প্যারেন্ট বাচ্চা উৎপাদন ও চাহিদা মেটানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেজন্য মানসম্পন্ন নিরন্তর গবেষণা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা দরকার। ৩. পশু খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং সরবরাহে অপর্যাপ্ততা রয়েছে। পর্যাপ্ত চারণভূমি না থাকায় এদেশে গবাদি পশু পালনের সবুজ ঘাসের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে একমাত্র শস্য উপজাত খড়ের পুষ্টিমান অত্যন্ত কম। সেক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য সারাদেশব্যাপী খামারিদের উন্নত জাতের ঘাস চাষ, অপ্রচলিত খাদ্যশস্য ও ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। ৪. নতুন প্রজন্মের রুচি এবং চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে চিকেন নাগেট, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গার, সমোচা, মিটবলসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার প্যাকেট-জাত খাবার যা কিছুকাল আগেও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। পণ্যের বাজারজাতকরণে নিত্যনতুন আইটেম কে উৎসাহিত করতে হবে। এর ফলে একদিকে খামারি ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারবে অন্যদিকে ভোক্তাদের নিকট পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত হবে। ৫. রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় উপখাত। তাই তৈরি পোশাক, হিমায়িত চিংড়ি রফতানির পরেই চামড়া ও চামড়া-জাত পণ্যের অবস্থান। অদূর ভবিষ্যতে দেশের জনগণের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাণীজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে প্রক্রিয়াজাত প্রাণিজ পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে কিন্তু ভবিষ্যতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা গেলে এখান থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ৬. স্কুল মিল্ক ফিডিং প্রোগ্রাম চালু করার মাধ্যমে মিল্ক-ভিটাসহ অন্যান্য কোম্পানিগুলোকে পুরোমাত্রায় পাউডার মিল্ক উৎপাদন চলমান রাখার জন্য সরকারী নির্দেশ বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের নজরদারিতে আনতে হবে। করোনা সঙ্কটকাল অতিক্রম হলে স্কুল মিল্ক ফিডিং চালু করা যেতে পারে এবং ওই কর্মসূচীতে দেশী ডেইরি কোম্পানিগুলোর প্রস্তুতকৃত মিল্ক পাউডার ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ৭. প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ও বিশেষ বরাদ্দ হতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ঋণ নীতিমালায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দফতরের রেজিস্ট্রার খামারিদের অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডেইরি ও পোল্ট্রি সেক্টরে এ সমস্ত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই অর্জন করা সম্ভব। ২০২০-২১ সালে মহান সংসদে যে বাজেট পাস হয়েছে তাতে দেখতে পাই মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতে টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ওই খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে বিগত সময়ে প্রদত্ত রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। সয়াবিন আমদানি শুল্ক শতকরা ৫ ভাগ থেকে কমিয়ে শূন্যে এবং সয়া প্রোটিন কনসেনট্রেটের আমদানি শুল্ক শতকরা ১০ ভাগ থেকে কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের উৎপাদন উপকরণ ব্যয় আরেক দফা হ্রাস পাবে এবং এই সকল খাতের মুনাফার পরিমাণ পূর্বের চাইতে বৃদ্ধি পাবে। ফলে খামারিরা খামার সম্প্রসারণ এবং নতুন নতুন খামার স্থাপনে উৎসাহিত হবেন। এছাড়া দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের সুরক্ষা এবং বিকাশের লক্ষ্যে প্রক্রিয়াজাত মুরগির অংশবিশেষ আমদানির সম্পূরক শুল্ক শূন্য থেকে শতকরা ২০ ভাগ এবং মূল্য সংযোজন কর শূন্য থেকে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ সকল পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে পোল্ট্রি খামারিদের পোল্ট্রি প্রক্রিয়াজাতকরণে উৎসাহিত করবে যা দেশের পুষ্টি নিরাপত্তায় জোরালো ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। পোল্ট্রি খাতের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপি আইসিসি) এর সভাপতি মশিউর রহমান টুটুল বাজেটকে পোল্ট্রিবান্ধব বলে স্বাগত জানিয়েছেন। একইভাবে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান লিন্টু বলেন- এই বাজেটে তারা সার্বিকভাবে অত্যন্ত খুশি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইতোমধ্যেই বেশকিছু কোম্পানি পোল্ট্রি ফিডের দাম কমিয়ে দিয়েছে। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোঃ রকিবুর রহমান টুটুল মনে করেন প্রস্তাবিত বাজেটে শতভাগ প্রত্যাশা পূরণ না করলেও আশা জাগিয়েছে। বাজেটের সুফল যেন প্রান্তিক খামারিদের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেয়া যায় সেটাই এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু যেমন কৃষিকে ভালবাসতেন, বঙ্গবন্ধুকন্যাও তেমনি আন্তরিক এবং উৎসাহী। মাটি, মানুষ, কৃষি-কৃষককে নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেমন রাজনীতি করেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তা ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাই সর্বসাধারণের মৌলিক চাহিদা ও প্রাপ্য অধিকার পূরণ করে উন্নয়নের যে দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার স্থাপন করেছে পোল্ট্রি ও ডেইরি সেক্টরকে সুরক্ষা এবং উৎপাদনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বাজেটে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। আমরা আশাবাদী, বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পথ ধরে সমৃদ্ধ আগামীর পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যময় অভিযাত্রা অব্যাহত থাকবে এবং অচিরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাল্লাহ। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ও সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
×