ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় পোল্ট্রি শিল্পের ভূমিকা

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ৫ জুলাই ২০২০

করোনায় পোল্ট্রি শিল্পের ভূমিকা

দেশের অন্যতম বহুমাত্রিক শিল্পের নাম পোল্ট্রি শিল্প। কেননা প্রাণিজ আমিষের চাহিদা আর ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রির মাংস ও ডিম অনন্য ভূমিকা রাখছে। প্রজন্মের মেধা বিকাশে পোল্ট্রির ডিম আর মাংসের অবদান আর্থিক বিচারে অতুলনীয়। একই সঙ্গে আত্মকর্মসংস্থান এবং ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এই শিল্পের ভূমিকা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্পে ডিম উৎপাদন, মুরগির বাচ্চা উৎপাদন এবং মাংস উৎপাদনসহ এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিড ও ওষুধসহ লিঙ্কেজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও পোল্ট্রির বিষ্টা, পাখনা ও উচ্ছিষ্টাংশও জৈব সারসহ অনেক নতুন শৈল্পিক উপাদান তৈরি হচ্ছে। এইসব মিলিয়ে পোল্ট্রি শিল্পটি বহুমাত্রিক সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে ডানা মেলতে শুরু করেছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পের উত্থানকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অপপ্রচার আর গুজবের আতঙ্ক ছড়িয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বারবারই শিল্পের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই করোনাকালে আমাদের পোল্ট্রি শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তার উপর হানা দিচ্ছে গুজব আর অপপ্রচারের কবলে শিল্পের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি। অনলাইন আর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়েছে এই বলে যে- পোল্ট্রির মাংস আর ডিমের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। প্রথমত বলা দরকার করোনাভাইরাস যে কোনভাবেই ছড়াতে পারে। পোল্ট্রির মুরগি বা ডিম করোনাভাইরাসের বাহক নয়। আমরা জানি, তৈরি পোশাক খাতের পর দেশে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছিল এই শিল্পটি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রেখে আসছে পোল্ট্রি শিল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব শিল্প হচ্ছে পোল্ট্রি। কারণ এেেত সবচেয়ে কম জমির ব্যবহার, সবচেয়ে কম দূষণ, সবচেয়ে কম পানির খরচ, সব ধরনের বর্জ্যই রিসাইকেল হয়। বেকারত্ব, দারিদ্র্য বিমোচন ও পুষ্টির সহজলভ্যতায় পোল্ট্রির উল্লেখযোগ্য অবদান দিন দিন বাড়লেও স্পর্শকাতর শিল্প হওয়ার কারণে প্রায়ই বড় রকমের ঝুঁকির মোকাবেলা করতে হয় এ শিল্পকে। অতীতে বার্ডফ্লুর মতো ভয়ানক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হয়েছে শিল্পসংশ্লিষ্টদের। এছাড়াও পোল্ট্রি শিল্পকে জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক মন্দা, উপকরণের উচ্চমূল্য এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত। এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রান্তিক খামারি আর বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের তিল তিল পরিশ্রমের ফলে শিল্পটি খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। ২০২০-২০২১ সালে দেশের চাহিদা পূরণ করে রফতানির বড় টার্গেট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল শিল্পটি কিন্তু এরই মাঝে করোনার ভয়াল থাবা শিল্পের অগ্রযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। করোনায় রোগ প্রতিরোধে পোল্ট্রির মাংস ও ডিম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষকে বছরে অন্তত ৪৩ দশমিক ৮০ কেজি প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি (বিপিআইসিসি)-এর মতে, বাংলাদেশের মানুষ প্রোটিন গ্রহণ করে গড়ে মাত্র ১৫ দশমিক ২৩ কেজি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, দেশে দৈনিক মুরগির মাংসের ঘাটতি জনপ্রতি প্রায় ২৬ গ্রাম এবং ডিমের ঘাটতি প্রায় ২৩ গ্রাম। ফলে শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ খর্বাকৃতির, ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষীণকায় হচ্ছে। অপরদিকে পোল্ট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সস্তা এবং সহজলভ্য হওয়ায় পোল্ট্রির মাংসকে বলা হয়- গরিবের পুষ্টির উৎস। আর ডিমকে বলা হয় পাওয়ার অব নিউট্রিশন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পোল্ট্রি এমন একটি শিল্প যার কারণে দেশের জনগণ সুলভে ও সহজে প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছে। প্রোটিন বা প্রাণিজ আমিষ ভারসাম্য খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন শরীরের হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ব্রয়লারের মাংস কম চর্বিযুক্ত হওয়ায় তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া ব্রয়লার মুরগির মাংসে ট্রাইফটোফ্যান নামে এ্যামিকো এসিড থাকে। বিষণœতা বোধ করলে এক বাটি চিকেন স্যুপ এনে দিতে পারে স্বস্তি। যা মানব মস্তিষ্কে সেরেটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে বিষণœতা দূর করে। তা ছাড়াও আমাদের শরীরের হেমোকিস্টাইন নামক একটি এ্যামিকো এসিড থাকে। হেমোকিস্টাইনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টের বিভিন্ন ধরনের কার্ডিও ভাস্কুলার রোগের বিরুদ্ধে কাজ করতে ব্রয়লার মুরগির মাংস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মাংস ফসফরাস সমৃদ্ধ হওয়ায় কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। শরীরে হজম প্রক্রিয়া সহজ করতে ভিটামিন বি-৬ এর ভূমিকা অতুলনীয়। তাছাড়া এই মাংসে নিয়াসিন নামক একটি ভিটামিন থাকে যাহা শরীরকে ক্যান্সারমুক্ত রাখে। অন্যদিকে ডিমের প্রোটিন মাংসপেশি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিমে বিদ্যমান ভিটামিন- ডি রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং হাড় ও দাত শক্ত রাখে। ভিটামিন-এ রাতকানা রোগের ঝুঁকি কমায় এবং ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ডিমের কলিন গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার হিসাবে কাজ করে। আমেরিকা হার্ট সংস্থার তথ্য মতে প্রতিদিন একজন মানুষের ৩০০ মি. গ্রাম কোলেস্টেরল প্রয়োজন। যা একটি ডিমে ১৮৬ মি. গ্রাম কোলেস্টেরল রয়েছে। করোনাকালে অপপ্রচারের শিকার পোল্ট্রি শিল্প করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দেশে অনেক ব্রয়লার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে ধস নামা আর অনিশ্চয়তার কারণে অনেক খামারি ডিম পাড়া মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। লকডাউনের কারণে হোটেল, রেস্তরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় কমেছে পোল্ট্রিও মাংস ও ডিমের চাহিদা। এছাড়া পরিবহনে সমস্যার কারণে মুরগি ও ডিম পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে লাভ করা তো দূরের কথা, মূলধন টেকানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন খামারিরা। উদ্যোক্তাদের দাবি, সামগ্রিকভাবে করোনার প্রভাবে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পোল্ট্রি শিল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটির টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিনিয়োগকৃত ২৫-৩০% ওয়াকিং ক্যাপিটাল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ফলে জুলাই মাস নাগাদ এই শিল্পের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ বেকারত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর একারণে ৪০ থেকে ৫০ লাখ পারিবারিক নির্ভরশীলের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম নাজুক পর্যায়ে চলে গেছে। একই কারণে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২০ লাখ নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা চরম ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২০-২০২১ বাজেট পোল্ট্রিবান্ধব ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে পোল্ট্রিবান্ধব হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে পোল্ট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)। এ বাজেট ‘কোভিড-১৯’ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সঙ্কটকালীন সময়ে পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদবান্ধব বাজেট তৃণমূল খামারিদের মাঝে নতুন করে আশা জাগিয়েছে। সরকারের এ আন্তরিক সহযোগিতা পোল্ট্রি শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগাবে বলে মন্তব্য করেছেন এ খাতের নেতারা।
×