ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চোরাবালিতে পোশাক রফতানি খাত

প্রকাশিত: ১৮:১২, ৫ জুলাই ২০২০

চোরাবালিতে পোশাক রফতানি খাত

দেশের পোশাক রফতানি খাত চোরাবালির মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে, অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে এই খাত বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘আপৎকালীন সময়ে এই খাতকে বাঁচাতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন জরুরী। আমাদের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলো দিচ্ছে। আমরাও দিতে পারি। কেননা এটা নীতি সহায়তার একটি বৈশ্বিক কাঠামো।’ ২২ হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগেই দেশের রফতানিতে খুব একটা সুখবর ছিল না। দুটি কারণে আমাদের রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এর একটি কারণ আমাদের সহজাত সক্ষমতা কমেছে। শ্রমিকদের দক্ষতা প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো বাড়েনি। এ ছাড়া মুদ্রা বিনিময় হারে ডলারের অবমূল্যায়ন না করা। সেখানে আমাদের রফতানিকারদের বড় ধরনের প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, বেড়ে যাওয়া মজুরি সমন্বয় করতে না পারা। কারণ পণ্যের কমে যাওয়া মূল্য থেকে এই মজুরি উদ্যোক্তাদের সমন্বয় করতে হচ্ছে। ফলে লোকসান হচ্ছে। অন্যদিকে মজুরি দিতে না পারায় কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, ৯৩৬ কারখানায় প্রায় ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৫৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছেন, করোনার কারণে ক্রেতারা ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছেন। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের অর্ডারও বাতিল করছেন ক্রেতারা। তবে, পরিস্থিতি যাই হোক, পোশাক শ্রমিকেরা সময় মতো মজুরি পাবেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, সরকার পোশাক শিল্পের পাশে আছে। শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ ঠেকাতে শ্রম অধিদফতরের নির্দেশনার আলোকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এজন্য গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় করোনা পরিস্থিতি নজরদারি ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিজিএমইএ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আশুলিয়া গাজীপুর ডিএমপি এলাকা ও নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গাকে ৪টি এলাকাভিত্তিক (জোনওয়াইজ) কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া করোনা বিষয়ে যে কোনো তথ্য জানানো বা জানার জন্য বিজিএমইএ উত্তরা অফিসে একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে। আপাতত কারখানা বন্ধের কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে শ্রমিকরা যেন করোনায় আক্রান্ত না হয়, তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘খাতটি চরম সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। একদিকে ব্রেক্সিট ইস্যু, ডলারের দাম সমন্বয় না করা, বিশ্ববাজারে চাহিদা কমায় পণ্যের দাম কমে যাওয়া, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে রীতিমতো সারভাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস ইস্যু।’ এর মধ্যে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এ উদ্যোক্তা। রফতানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পুরো রফতানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি। পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবধরনের পণ্য আমদানি স্বাভাবিকের পর যখন উৎপাদন শুরু হলো তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রয়াদেশ। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে পোশাক কারখানা রয়েছে চার হাজার ৬২১টি। বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে ৪১ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন, যার অধিকাংশই নারী। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি-এর আগেই জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বায়াররা অর্ডার বাতিল করছেন। তারপরও কারখানা চালু রাখা হয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক ক্ষতির যথাযথ হিসাব করা না গেলেও ধীরে ধীরে এ ক্ষতির প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক খাত, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, স্বাস্থ্য খাত, সরকারী অর্থায়ন এবং মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মন্দার কবলে পড়বে দেশের অর্থনীতি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি খাতে বহুমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে পোশাক খাত। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশেরে রাজস্ব খাতের সিংহভাগই পূরণ করে থাকে তৈরি পোশাক খাত। সুতরাং রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ক্রমাগত ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার প্রেক্ষিতে এ খাতে ঝুঁকির বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের বলেই প্রতীয়মান হয়। জানা যায়, করোনার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে পোশাক খাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি রফতানি অর্ডার বাতিল হয়েছে’। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সঙ্কট যত দীর্ঘায়িত হবে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই অর্থনীতিতে এর প্রভাব মোকাবেলায় সরকারকে প্রয়োজনীয় পূর্ব প্রস্তুতিসহ জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া এবং জরুরী অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা মনে করছেন, মোকাবেলা করার সক্ষমতার ওপরই অর্থনীতির ধাক্কা সামলানোর বিষয়টি নির্ভর করছে। করোনাভাইরাসের প্রভাব, মোকাবেলায় সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি মনিটরিং করছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতরের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরী বৈঠক করে ন্যাশনাল কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনার কারণে রফতানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। শিল্প রক্ষায় সব ধরনের নীতিগত সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তৎপরতাও রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশেরে অর্থনীতির প্রধান দুই খাত রেমিটেন্স এবং রফতানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা বিপুলসংখ্যক প্রবাসী কাজে যোগ দিতে না পারলে রেমিটেন্স আহরণে বড় ধরনের ঝুঁকি আসবে। বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। দুঃখজনক যে, এসব দেশে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত হওয়ায় তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়া, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং শাক-সবজি রফতানিও বন্ধ হওয়ার পথে। বলাইবাহুল্য, ভাইরাসটির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। জার্মানিও ধুঁকছে। দেশগুলোতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছে না। অনেক পোশাকের ব্র্যান্ড তাদের শত শত বিক্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে। ফলে এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে দেশের নীতিনির্ধারকদেরই। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ বেশ আত্মতৃপ্তিতে ছিল। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ বলেই সবাই আশঙ্কা করছেন। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থনীতির এই উৎকণ্ঠার মধ্যে করণীয় কী তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে প্রথম কাজটি হবে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যও যথাযথ পরিকল্পনা জরুরী। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ রয়েছে যাতে কারখানা বন্ধ না হয়। এখন সরকারকে এ ব্যাপারে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। আর সামগ্রিকভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়াসহ খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবায় জোর দেয়াসহ যেসব সুপারিশ করেছেন বিশ্লেষকরা সরকার তা আমলে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। তবে কোভিড-১৯ ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্যেও রফতানিসহ বিভিন্ন খাতে সম্ভাবনা জানান দিচ্ছে। পোশাক রফতানিকারক শীর্ষ বাজার চীন থেকে অর্ডার কমে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। করোনার কারণে বাতিল এবং স্থগিত হওয়া তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ ফেরত আসছে। এর বড় অংশই পুনর্বহাল করেছে বিদেশী ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা। এদিকে ইউরোপ-আমেরিকায় ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। সেসঙ্গে বাংলাদশে নতুন রফতানি আদেশও আসতে শুরু করেছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার সুফল নেয়ারও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এই মুহূর্তে জীবন ও জীবিকা দুটোকে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে করোনা সংক্রমণের কঠিন সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পাশাপাশি ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিকের জীবন ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার কথা বিবেচনায় রেখে কারখানা খোলা রাখতে হচ্ছে। এই সঙ্কট উত্তরণে সরকার অতীতের মতো আগামী ২০২০-২১ বাজেটেও আমাদের পাশে থাকবে বলে আশা করি।’
×