ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ৪ জুলাই ২০২০

মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু

ফিরোজ মান্না ॥ পালেরমো প্রোটোকল অনুযায়ী সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। পাচারকারীরা লিবিয়ায় সম্প্রতি ২৬ জন বাংলাদেশীর কাছ থেকে বাড়তি টাকা না পেয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। ওই ঘটনার পর দেশে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। লিবিয়ার ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব অন্তত ২০ জনকে আটক করেছে। একই প্রটোকলে গত ৬ জুন কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য পাপলুকে গ্রেফতার করেছে। মানব পাচার নিয়ে সারাবিশ্বেই চরম উদ্বেগ বিরাজ করছে। মানব পাচার রোধে এ বছরের গোড়ার দিকে ‘পালেরমো প্রোটোকল’ অনুসমর্থনে মানব পাচার বন্ধের জন্য বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করেছে। বর্তমানে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই প্রোটোকলের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে। মানব পাচারকারী যেই হোক তাকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় প্রোটোকলের আওতায় এক সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আইনগতভাবে কার্যকর যোগ্য এই প্রটোকলের অনুসমর্থনের নথি জাতিসংঘেও পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র ও আইওএম এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, উন্নত দেশগুলো মানব পাচারের বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে বিভিন্ন দেশের সরকারের ওপর জাতিসংঘের চাপ রয়েছে। বলপূর্বক শ্রম, সেবা ও যৌনকর্মে বাধ্য করা এবং অভিবাসী পাচার বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার পাচারের তথ্য গোপন করায় এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের অনেক অভিবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। চলাচলে সীমাবদ্ধতা, ঋণের চক্রে পরা, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো শোষণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী ও পুরুষ এবং শিশুরাই মানব পাচারকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। সকল স্তরে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ, বেসরকারী খাত এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানব পাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বহু মনুষ অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিবাসীরা পাচারকারীদের শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ করাণে টিআইপি প্রতিবেদনে টানা তিন বছর বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘ওয়াচ লিস্টে’ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার নির্মূলে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না। মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ আসে প্রতিবেদনে। এদিকে কুয়েতে আটক শহীদ ইসলাম পাপলুর বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা মাধ্যমে দেশ থেকে মানব পাচার করে আসছে। দেশটিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ১০০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের প্রেফতার করেছে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ। বাংলাদেশের এমপি কাজী পাপলুর নামও এই তালিকায় ছিল। কুয়েতে বিরাট ব্যবসা রয়েছে তার। মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে কুয়েতেই অবস্থান করছেন তিনি। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতে মানব পাচারের সঙ্গে এমপি শহীদ ইসলাম পাপলুর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কুয়েতের নিরাপত্তা বিভাগ বাংলাদেশের পাপলু খুঁজছে যিনি অবৈধ ভিসার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সিআইডি অর্থ পাচার ও মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পাপলুকে গ্রেফতার করেছে। তাকে বেশ কয়েকদিন সিআইডি রিমান্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। আইওএম (আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা) জানিয়েছে, পাচারের শিকার মানুষ যৌন শোষণ, জোরপূর্বক শ্রম, বহু ও জোরপূর্বক বিবাহ, শিশু কর্মীদের শোষণ, পথশিশুদের পাচার এবং অঙ্গবাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিবাসী কর্মীরা অনৈতিক নিয়োগে ঢুকছেন। পাচারকারীরা ভারত, পাকিস্তান ও এশিয়ার মধ্যপূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর ব্যবহার করে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। ভয়বহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের পাচার করা হচ্ছে। নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে সচেতনতার অভাব এবং অভিবাসনের জন্য অনেক বেশি খরচের কারণে মানুষ অনিরাপদভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মাইগ্রেশন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক হিসেবে আমরা অভিবাসীরা যে দেশে থাকছেন, যে দেশ থেকে যাচ্ছেন এবং যে দেশগুলো দিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাদের অধিকার ও ভাল থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। একইসঙ্গে মানব পাচার রোধে আমরা সব সময় সরকারের পাশে আছি। মানব পাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১২ সালের মানাব পাচার প্রতিরোধ আইন অন্যতম। ২০১৭ সালের ওই আইনের বিধি করে বাস্তবায়ন করছে সরকার। এছাড়া মানব পাচার রোধে সরকার ২০১৮-২০২২ ব্যাপী একটি জাতীয় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান জানিয়েছেন, মানব পাচারকারীদের বিচার করার জন্য ২০১২ সালের ‘বাংলাদেশের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই ট্রাইবুনাল গঠনের আর অগ্রগতি হয়নি। পাচার আইনে বিচার দীর্ঘসূত্রতার কারণে মানব পাচার আইনে করা মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। গত কয়েকবছরে দেশে মানব পাচার আইনে ৪ হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর স্থবির অবস্থায় পড়ে আছে। আইনে থাকলেও সাত বছরে এ সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল না গঠন করাই এ দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। প্রতি জেলায় ট্রাইব্যুনাল করা কঠিন। তবে যেসব জেলা থেকে মানব পাচার বেশি হয়েছে সেসব জেলায় ট্রাইব্যুনাল হতে পারে। আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ না হলে ট্রাইব্যুনাল সেটি উচ্চ আদালতে পাঠাবে। মানব পাচার ও অভিবাসন ভিন্ন বিষয়। পৃথিবীর উন্নয়নে অভিবাসন অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু আমাদের দেশে মানব পাচারের ৯০ শতাংশ হয়ে থাকে অবৈধ অভিবাসন কেন্দ্রিক। এসবের মূল কারণ হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। কঠোর হাতে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ না হলে মানব পাচার থামনো সম্ভব হবে না।
×