ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৩০ লাখ টন কিনতে হবে সরকারকে ॥ ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ইফপ্রির প্রস্তাব

প্রকাশিত: ২২:০৬, ৪ জুলাই ২০২০

৩০ লাখ টন কিনতে হবে সরকারকে ॥ ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ইফপ্রির প্রস্তাব

কাওসার রহমান ॥ বাজারে ধানের দাম প্রতিকেজি ২৬ টাকায় উন্নীত করতে হলে সরকারকে ৩০ লাখ টন ধান ক্রয় করতে হবে। এজন্য খাদ্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। অর্থাৎ সরকার যত বেশি ধান ক্রয় করবে বাজারে ধানের দাম তত বৃদ্ধি পাবে। সরকার ২০১৯ সালে যদি ধান-চাল সংগ্রহের পুরোটাই ‘ধান আকারে’ সংগ্রহ করত তাহলে ধানের বাজার মূল্য প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। তাই কৃষকের উপকারের জন্য সম্পূর্ণ সরকারী সংগ্রহ ধান হিসাবে ক্রয় করার প্রস্তাব দিয়েছে খাদ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)। এজন্য সরকারী ক্রয় ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছে গবেষণা সংস্থাটি। কৃষকরা ধান কাটার মৌসুমে ধানই বিক্রি করেন। তাই সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করলে কৃষকরা সেই ক্রয় মূল্য পাবেন। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণে চাল সংগ্রহ করলে বাজারে চালের খুচরা দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে যারা নিয়মিত চাল কিনে খান বিশেষত শহরের দরিদ্র লোকজন, তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান করা এবং স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের জন্য খুচরা বাজারে সাশ্রয়ী মূল্য বজায় রাখা সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কৃষকরা তাদের ধান খাদ্য অধিদফতরের কাছে বিক্রি করার জন্য স্থানীয় সরবরাহ ডিপোতে (এলএসডি) নিয়ে আসবেন। বোরো ফসল তোলার মৌসুম বর্ষাকালে হওয়ায় কৃষকদের ধানে সাধারণত বেশি আর্দ্রতা থাকে। এসময় কৃষকদের পক্ষে ধান শুকানো এবং সরকারের অনুমোদিত আর্দ্রতা রক্ষা করা খুব কঠিন। সরকারের কাছে বিক্রির সময় সর্বোচ্চ অনুমোদিত আর্দ্রতার পরিমাণ হচ্ছে ১৪ শতাংশ। সুতরাং কৃষকদের ধানের আর্দ্রতার পরিমাণের ভিত্তিতে ক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ যারা ১৪ শতাংশ আর্দ্র ধান সরবরাহ করবেন তারা ঘোষিত ক্রয় মূল্য গ্রহণ করতে পারবেন এবং বেশি আর্দ্র ধান যারা বিক্রি করবে তারা সরকারের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দাম পাবেন। সরকারী ক্রয় ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র কৃষকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ক্রয়ের জন্য সর্বনিম্ন পরিমাণ ২০০ কেজি এবং সর্বোচ্চ ২ টন পর্যন্ত ধান বিক্রির সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান ধান সংগ্রহ পদ্ধতি ব্যবহার করেই কৃষকদের অর্থ প্রদান করা যেতে পারে। কৃষকদের সরবরাহকৃত ধান সরকার মনোনীত চালকল মালিকরা এলএসডি থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। তারা ধান কিনবেন না। অতিরিক্ত আর্দ্রতাসহ ধানের ক্ষতি এড়াতে চালকল মালিকদের একদিনের মধ্যেই ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্র ধান নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে ধান নষ্ট না হয়। বর্তমান নিয়মানুসারে ১৪ শতাংশ আর্দ্র ধান থেকে চাল বের করার অনুপাত ০.৬৭ (অর্থাৎ প্রতি ১০০ টন ধান থেকে ৬৭ টন চাল পাওয়া যায়)। এক্ষেত্রে যেহেতু কৃষক বেশি আর্দ্র ধান নিয়ে আসবেন। তাই আর্দ্রতা অনুযায়ী ধান থেকে চালে রূপান্তর করার অনুপাত নির্ধারণ করা হবে। কারণ ধানের আর্দ্রতা বেশি হলে এই অনুপাত কম হবে। সরকারের এই ধান সংগ্রহ অভিযানে চালকল মালিকদের ভূমিকা হবে এলএসডি থেকে ধান নিয়ে ওই ধান ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করে পুনরায় এলএসডিতে সরবরাহ করা। এক্ষেত্রে চালকল মালিকরা পরিবহনের জন্য প্রতি টন হিসেবে ভাড়া পাবেন ও মিলিং চার্জ হিসেবে নগদ অর্থ পাবেন। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে, যেসব কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রয় করবেন এবং যারা সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন না তারা উভয়েই উপকৃত হবেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ধানের মূল্য প্রভাবিত করার জন্য ধান সংগ্রহের পরিমাণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে ইফপ্রি। তবে এই নীতি প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে হলে বর্তমান সরকারী ক্রয় ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হবে। বিগত ২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে বাংলাদেশের কৃষকরা ধানের দাম কম পেয়েছিলেন। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় ইফপ্রিকে বাংলাদেশ সরকারের বোরো ধান সংগ্রহের বিষয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করার জন্য অনুরোধ করে। ইউএসএআইডির অর্থায়নে ইফপ্রি এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করে। সরকারী ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান প্রসঙ্গে অবশ্য আরও দুটি পরামর্শ দিয়েছে ইফপ্রি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গবেষণা করে মোট ৩টি প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও প্রথম প্রস্তাবটির মতো। এক্ষেত্রে ধানের বাজার মূল্য প্রতি কেজি ২৬ টাকায় উন্নীত করতে হলে সরকারকে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০ লাখ টন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এবং এই ধানের পুরোটাই কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। আর এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রথম প্রস্তাবের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। তবে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারে সীমাবদ্ধতা হলো- বর্তমানে সরকারের খাদ্য গুদামে খাদ্যশস্য ধারণ ক্ষমতা ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন। আর ৩০ লাখ টন ধান সংগ্রহ করলে, যা চাল আকারে দাঁড়াবে ২১ লাখ টন, যা বিদ্যমান গুদামে রাখা সম্ভব হবে না। ফলে খাদ্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর তৃতীয় প্রস্তাবটি হলো খোলা দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহ করা। যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এবং এই ব্যবস্থা কার্যকরী করলে চালকলের সঙ্গে পরিচালনা ও পরিবহনের দায়িত্ব সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তরিত হবে। তবে এই নীতি গ্রহণ করলে কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হবে না। কারণ সরকারকে ব্যবসায়ী তথা মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনতে হবে, কৃষকদের কাছ থেকে ধান নয়। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে আরও বঞ্চিত হবে। গবেষণা প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য তিনটি বিকল্প নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা নির্ভর করছে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মূল লক্ষ্যের ওপর, অর্থাৎ সরকারী ক্রয়ের লক্ষ্য কী কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান করা বা নাকি পিএফডিএস মজুদের লক্ষ্য পূরণ করা। যদিও দুটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ, একাধিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য একাধিক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ক্রয় কর্মসূচী হচ্ছে একটি একক নীতিগত ব্যবস্থা, যা ফসল তোলার মৌসুমে কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান এবং পিএফডিএস মজুদ তৈরির করার মতো দুটি ব্যবস্থা একই সময়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় না। তাই মূল উদ্দেশ্য যদি হয় কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান করা, তাহলে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারে। তবে যদি মূল লক্ষ্য হয় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখা, তাহলে তৃতীয় প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। যেহেতু কৃষকরা ধান কাটার মৌসুমে ধানই বিক্রি করে। তাই সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করলে কৃষকরা সেই ক্রয় মূল্য পাবে বলে আশা করা যায়। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণে চাল সংগ্রহ করলে বাজারে চালের খুচরা দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে যারা নিয়মিত চাল কিনে খায় বিশেষত শহরের দরিদ্র লোকজন, তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। সুতরাং কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান করা এবং স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের জন্য খুচরা বাজারে সাশ্রয়ী মূল্য বজায় রাখা সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। গবেষণায় দেখা যায়, সরকার যদি বাজার থেকে বেশি করে ধান কেনে তবেই বাজারে ধানের দাম বেড়ে যায়। যার সুফল কৃষক পায়। কিন্তু ধান কম কিনলে এবং বেশি চাল কিনলে তার সুফল পায় চালকল মালিকরা। তারা তখন যোগসাজশ করে বাজারে ধানের দাম কমিয়ে ফেলে। এতে কৃষক বঞ্চিত হয়। সেটি ২০১৯ সালে হয়েছিল। এবছর সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করেছিল মোট সংগ্রহের ৮১.১০ শতাংশ। অবশিষ্ট ১৮.৯০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে। এবছর দেশে মোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন। যার মধ্যে বোরো চালের পরিমাণ ছিল ৫৩.৮ শতাংশ। আর সরকারের চাল সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ২০ হাজার টন। যা ছিল মোট উৎপাদনের ৭.২৫ শতাংশ। এবছর মোট ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ৩৯৯,৮৬২ টন, যা ২০১৯ বোরো সংগ্রহ মৌসুমে মোট বোরো ধান উৎপাদনের মাত্র ১.৩৭ শতাংশ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধান-গমের উৎপাদন মৌসুমে সরকার মিলারদের জন্য সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করে না। ধান, চাল ও গমের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয় কৃষকের জন্য। অর্থাৎ কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ধান বা গমের উপযুক্ত মূল্য পায়। সে হিসাবেই সরকার মূল্য নির্ধারণও করে থাকে। আগে ধান কাটা মৌসুম শুরু হলে ধানের মূল্য ঘোষণা করা হতো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষকের সুবিধার জন্য মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ধান চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করে। যাতে ধানের বাজারে সরকারের ঘোষণার প্রভাব পড়ে এবং ধানের দাম বৃদ্ধি পায়। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্য দাম পায়। অর্থাৎ কৃষকদের স্বার্থেই সরকার ধানের দাম ঘোষণা করে। তাই এই দাম কৃষককে দিতে হলে চালের পরিবর্তে ধান সংগ্রহ করাই যুক্তিযুক্ত। মনে রাখতে হবে কৃষক ধানে দাম না পেলে এক সময় ধান উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এখন কৃষকের সামনে অনেক বিকল্প আছে। তারা অন্য ফসলে বেশি লাভবান হতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, শুধু ধান সংগ্রহ-ই নয়, ক্রমান্বয়ে ধান সংগ্রহে পরিমাণ ৩০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়া উচিত। আগে মনে করা হতো, সরকারের খাদ্যশস্য মজুদ ১৫ লাখ টন হলেই যথেষ্ট। কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার সময় দেখা গেছে, এই সংগ্রহ অপ্রতুল। ওখন বিশেষজ্ঞরা এই মজুদ ২৫ লাখ টনে উন্নীত করার পরামর্শ দেন সরকার। দিন দিন বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বে খাদ্য সঙ্কটের সৃষ্টি হলে কোন দেশ খাদ্যশস্য বিক্রি করতে চায় না। যেটি ২০০৭-২০০৮ সালে দেখা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ঘুরেও কোথাও খাদ্যশস্য পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশে এই পণ্যটির দাম ২৫০ টাকা (কেজিপ্রতি) ওপর উঠে যায়। তাই নিজের সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য সরকারের সংগ্রহ মজুদ ৩০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়া উচিত। এবং প্রতি ১০ বছর পর পর এই মজুদ ক্ষমতা ৫ লাখ টন করে বৃদ্ধি করা উচিত। এতে দেশের খাদ্যশস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হাত শক্তিশালী হবে। এসব বিবেচনায় কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম দুটি প্রস্তাবটি-ই আকর্ষণী। এতে কৃষক এবং চালকল মালিক উভয়ই লাভবান হবে। কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করবে, আর মিল মালিকরা সেই ধান নিয়ে ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করে সরকারের কাছে সরবরাহ করবে। এজন্য মিলাররা ভাড়া ও ভাঙ্গানোর চার্জ পাবে। যেটি এখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ঘটছে। বিদেশী ক্রেতারা কাপড় ও ডিজাইন সরবরাহ করে আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সেই ডিজাইন অনুযায়ী কাপড় তৈরি করে ক্রেতাদের সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা কাটিং ও মেকিং (সিএম) চার্জ পায়। তাই সরকারের উচিত ক্রয় ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো। যুগ যুগ ধরে এই নিয়মে পড়ে না থেকে ক্রয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা উচিত। বাজারে ধান সংগ্রহের প্রভাব ॥ ধান সংগ্রহ কর্মসূচী থেকে ধানের বাজার মূল্যের ওপর কী প্রভাব পড়বে? এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ধানের দাম কমে যাওয়ায় সরকার ২০১৯ সালে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এতে বাজারে ধানের দামে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকার ২০১৯ সালে ৩৯৯,৮৬২ টন বোরো ধান সংগ্রহ করে। এতে ধানের বাজার মূল্য ৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৯ সালে ধানের পরিমাণে মোট ধান ও চালের সংগ্রহ ছিল ২১.২ লাখ টন। সরকার যদি চালের পরিবর্তে পুরোটা ধান হিসেবে সংগ্রহ করত, তাহলে ধানের বাজার মূল্য প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি হতে পারত। এতে কৃষক বেশি দাম পেত। তাই ধানের বাজার মূল্য সরকার ঘোষিত প্রতি কেজি ২৬ টাকায় উন্নীত করতে হলে সরকারকে মোট ৩১ লাখ টন ধান ক্রয় করতে হবে। যার পরিমাণ হচ্ছে ধানের বাজারে সরবরাহের ১৮.৭ শতাংশ বা ২০১৯ সালে মোট বোরো ধানের উৎপাদনের ১০.৫ শতাংশ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র কৃষক ॥ গত বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম থাকায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর। গবেষণা ফলাফল থেকে দেখা যায়, কম দামের কারণে দেশের ক্ষুদ্র কৃষকরা (সকল বোরো কৃষকের ৪৭ শতাংশ, যারা ০.৫ থেকে ১.৪৯ একর জমি চাষ করে) অন্যান্য চাষীর তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ তারা ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিক্রি হওয়া বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে দিয়েছিল। দাদন নিয়ে ধান চাষকারী কৃষকরাও (সকল কৃষকের ৩৩ শতাংশ) ধানের দাম কমে যাওয়ার কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ তাদের জমির মালিকদের দ্রুত নগদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছিল। অন্যদিকে ভাগচাষীরা (সকল কৃষকের ২৬ শতাংশ) জমির ভাড়া বাবদ উৎপাদিত ধানের অংশ ধানে পরিশোধ করেছিল। প্রান্তিক চাষীদের (সকল কৃষকের ৩৬ শতাংশ যারা ০.৫ একরেরও কম জমি চাষ করে) বেশির ভাগই নিজের চাহিদা পূরণের জন্য ধান চাষ করে। সুতরাং ভাগচাষী ও প্রান্তিক চাষীরা বোরো ধানের দাম কম থাকার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ২০১৯ সালের ক্রয় মৌসুমে ধান বিক্রয়কারী সকল কৃষকের মধ্যে সরকারের কাছে ধান বিক্রয় করেছে মাত্র ১.৩৪ শতাংশ কৃষক। বিদ্যমান ক্রয় প্রক্রিয়ায় লাভবান চালকল মালিকরা ॥ ক্রয় প্রক্রিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান চালকল মালিকরা। তারা মূলত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাইব্রিড ধান কেনার মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করেছিলেন। এই ধানের দাম উচ্চ ফলনশীল ধানের চেয়ে ২৪.৮ শতাংশ কম ছিল। তারা খাদ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে এই চাল প্রক্রিয়াজাত করে সরকারের কাছে ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বোরো ধান উৎপাদনের মধ্যে হাইব্রিড ধানের পরিমাণ ছিল ১৮ শতাংশ (বিবিএস ২০১৯)। সরকারের কাছে চালকল মালিকদের বিক্রি করা মোট চালের ৯৪ শতাংশই ছিল হাইব্রিড ধানের চাল। চালকল মালিকরা এভাবে প্রতারণা করে কম দামের হাইব্রিড ধান কিনে সরকারের কাছে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা বিক্রি করে লাভবান হয়েছিলেন।
×