ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ সুদানে ‘বাংলাদেশ রোড’ ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ৪ জুলাই ২০২০

দক্ষিণ সুদানে ‘বাংলাদেশ রোড’ ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে

ফিরোজ মান্না ॥ বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্ট-১৯ দক্ষিণ সুদানের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্যার্থে ‘হাই তিরিরি নামক গ্রাম ও ‘মুন্দ্রি-মারিদি’ মূল সড়কের মাঝে একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। ‘সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ রোড’। সড়কটি নির্মাণের ফলে হাই তিরিরি গ্রামটির সঙ্গে মুন্দ্রি শহরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয়রা এই সড়কটি নির্মাণে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, শিশুদের স্কুলে যাতায়াত, বায়োজ্যেষ্ঠ ও স্থানীয় জনগণের চলাচল এবং বাণিজ্যিকভাবে গ্রামবাসী উপকৃত হচ্ছেন। স্থানীয় জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে সড়ক নির্মাণের ফলে ব্যান ইঞ্জিনিয়ার (কনস্ট্রাকশন)-১৯‘র অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রশাসন নবনির্মিত সড়কটির নামকরণ করেন বাংলাদেশ রোড। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কটি উদ্বোধন করা হয়। দক্ষিণ সুদানের বহুল প্রচারিত ‘রেডিও মিরায়া’ ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘জুবা মনিটর’ বাংলাদেশ রোড নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবেদন প্রচার করে। এটি দক্ষিণ সুদানে মিশন এলাকায় কর্মরত বাংলাদেশ সেনাসদস্যসহ বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। এই সড়ক নির্মাণ করে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোর (কনস্ট্রাকশন)-১৯ ও বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলেছে। সড়কটি অনলাইন ডিজিটাল ম্যাপ ও আনমিস অফিসিয়াল ম্যাপেও হালনাগাদ করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ সড়কটি এখন ভীষণভাবে পরিচিতি পেয়েছে। দক্ষিণ সুদান থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, তেল সমৃদ্ধ সদ্য স্বাধীন দেশ দক্ষিণ সুদান। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির মানুষ ৯ বছর আগে শৃঙ্খল মুক্ত হন। সম্পদশালী সুদানের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে উত্তর সুদানের সঙ্গে গৃহ বিবাদ লেগেই ছিল। উন্নয়ন বৈষম্যের কারণে দুই সুদানের মধ্যে চলে আসা গৃহযুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। অবশেষে সেই গৃহ বিবাদের অবসান ঘটে ২০১১ সালের ৯ জুলাই। এই দিন পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় আরও একটি স্বাধীন দেশ। তার নাম হয় দক্ষিণ সুদান। জন্মের পর থেকেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও গৃহযুদ্ধে বিপর্যপ্ত হয়ে পড়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি। সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ববহুল দেশগুলোর অন্যতম ছিল। উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর এলাকার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। দক্ষিণাঞ্চলের অনগ্রসর এলাকার অধিবাসীদের অধিকাংশই অমুসলিম। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, ও রাজনৈতিক বিভাজন ও মতবিরোধের ফলে সুদানে আধুনিক কালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। অশান্ত দক্ষিণ সুদানে শান্তি ফেরাতে জাতিসংঘের হয়ে কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষায় ইউনাইটেড ন্যাশনস মিশন ইন সাউথ সুদান (আনমিস) নিয়োগ পান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশটিতে শান্তিরক্ষার পাশাপাশি নানা সামাজিক কাজ কর্মে অংশ নেন। তারা বিধস্ত দক্ষিণ সুদানের রাস্তা ঘাট নির্মাণ করেন। দেশটির সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্মাণ করা রাস্তার নাম করণ করেন ‘বাংলাদেশ রোড’। এই রোডই বাংলাদেশকে আরও সম্মান বয়ে এনে দিয়েছে। সেনাসদস্যদের রাত দিনের প্রচেষ্টায় নির্মিত রোড দিয়ে এখন জাতিসংঘ মিশনের সব দেশের সেনা ও দেশটির মানুষ চালাচল করেেছন। দক্ষিণ সুদান থেকে সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা বাংলাদেশ সড়কটি নির্মাণ করেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিনিয়ার কন্টিনজেন্ট-১৯। তারাই এই কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে যাচ্ছে। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত দূর্গম অঞ্চলের মানুষদের প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সেবা। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার কন্টিনজেন্ট-১৯ দেশটির প্রদান মহাসড়ক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের অংশ হিসেবে ‘মুন্দ্রি-মারিদি-ইয়াম্বিয়’ (২৫৬ কিলোমিটার) সড়ক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজের শান্তিরক্ষা মিশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত পান। এ লক্ষে মুন্দ্রি এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মহাসড়কটির সংস্কার ও মেরামত কাজ চলাকালীন সময়ে এক্সিকিউটিভ উাইরেক্টর, মুন্দ্রি কাউন্টি মিঃ তাবান জ্যাকসন ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং স্থানীয় কিছু গ্রামভিত্তিক অনুন্নত এলাকার সঙ্গে ‘মুন্দ্রি-মারিদি’ মূল সড়কের সংযোগ সড়ক নির্মাণের অনুরোধ জানান। দক্ষিণ সুদান থেকে সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ মিশন আনমিসে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত ২০১১ সাল থেকে অত্যন্ত দক্ষতা এবং সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সদর দফতরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুবই অল্প সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৮৫০ জনের একটি পদাতিক কন্টিনজেন্ট দক্ষিণ সুদানে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর কিছু দিনের মধ্যে দেশটিতে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। উল্লেখ্য, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ১৫ লাখের ওপর মানুষের প্রাণহানির পর বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় আরেকটি স্বাধীন দেশ- দক্ষিণ সুদান। জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩তম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দেশটি। আফ্রিকার নতুন এই দেশটির স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন রাজধানী জুবায় নাচে গানে মেতে উঠেছিল সেদিন দক্ষিণ সুদানের মানুষ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংবিধানে সই করে শপথ নিয়েছিলেন সালভা কীর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির ও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। বিদেশী বহু কূটনীতিক ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সেদিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সালভা কীর। গণভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা লাভ করে।
×