ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৪৫ কারখানায় তৈরি হচ্ছে

মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা থামছেই না

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ৪ জুলাই ২০২০

মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা থামছেই না

শংকর কুমার দে ॥ করোনার মধ্যেও মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছেই। মিয়ানমার থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আসছে হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর উদ্ধার হচ্ছে ৪ কোটি পিস ইয়াবা। এসব উদ্ধার করছে বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র‌্যাব, পুলিশ, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৪৩ পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। মিয়ানমারের ৪৫ কারখানায় তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা। মিয়ানমারের কাছে ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এই তো, মাত্র এক সপ্তাহ আগে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ৫ জনকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ৩০ হাজার পিস ইয়াবার দুটি চালান উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে রাজধানী ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন রুট, যার একটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা। এই উপজেলায় থেকে এক বছরে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে উঠেছে ৪৫ ইয়াবা তৈরির কারখানা। মিয়ানমার থেকে প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে সমুদ্রপথে ট্রলার ও নৌকাযোগে মরণ নেশা ইয়াবার চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই আসছে। বাংলাদেশের মাদকসেবীদের কাছে হেরোইন, ফেনসিডিলকে পেছনে ফেলে মরণ নেশা ইয়াবাই দখল করে নিয়েছে। এ জন্য ইয়াবা পাচার রোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পরও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চোরাচালান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার কারখানাগুলো ও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার পরও ইয়াবা বন্ধ হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে তাদের দেশের সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা ইয়াবা তৈরির কারখানার তালিকা দেয়া হয়। প্রদত্ত তালিকায় মিয়ানমারকে ৪৫টি ইয়াবা কারখানার বিষয়ে তথ্য দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৩৭টি কারখানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি হচ্ছে, যার বাজার বাংলাদেশ। টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমারের যেসব এলাকায় ইয়াবা কারখানা স্থাপিত হয়েছে - মংডু, সিটওয়ে, মইং, কুখাই, নামকখাম, শান, ওয়া, মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং, মংইয়াং ও পাংশাং, কুনলং, টেংইং, সেন, লুই হুপসুর, কাইয়াং, মাহাজা এ্যান্ড হুমং, কেউও, মাওকমাই, কাকাং মংটন কাশিন ও আইক্কা। ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলোর মধ্যে ১০টি গড়ে উঠেছে মংডু এলাকায়ই। মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মিয়ানমারে ওয়াং এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় এই মেথাএম্ফিটামিন পিল বা ইয়াবার উৎপাদনকারী। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজন এক সময় আফিম ও হেরোইন উৎপাদনে জড়িত ছিল। এখন নাফ নদী পার হয়ে নৌযানে ইয়াবার চালান টেকনাফ, কক্সবাজার হয়ে সরাসরি রাজধানীতে চলে আসে। এছাড়া সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ইয়াবাসহ অস্ত্রের চালান আসছে। এই ইয়াবার চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা বাধায় চলে আসছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হওয়ার পর সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করেছিলেন, ইয়াবা পাচারও কমে যাবে। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়ন করে দিলেও ইয়াবা চোরাচালান ঠিকই চালু থেকেছে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে মিয়ানমারের নাগরিক ইয়াবাসহ ধরা পড়ার ঘটনা ও মামলা হওয়া অব্যাহত আছে। দুই বছর আগে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বৈঠকের সময় ইয়াবা কারখানা এবং এর মালিকদের একটি তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমার ওই তালিকার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। এর আগেও দেশটি ইয়াবা বন্ধে কোন ধরনের সহযোগিতা করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া বিজিবির এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সংসদ ও দেশটির শান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, মংডু ও বুথিডং এলাকার সীমান্তরক্ষী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৬টি স্থানে ৪৫টি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, করোনা মহামারীর মধ্যেও মাদক পরিস্থিতি এখন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে ইয়াবার বিক্রি ও ব্যবহার আবার অতীতের স্থানে চলে যাচ্ছে। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। মোট বিক্রি হওয়া মাদকের ২০-২৫ শতাংশই ধরা পড়ে। বাকি ৭৫ শতাংশ মাদকসেবীদের কাছে চলে যেতে পারে। তিনি দাবি করেন, নিয়মিত অভিযানের কারণেই মাদক উদ্ধার হচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখে। এদের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত বলে ধরে নেয়া যায়। মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইয়াবা। ইয়াবা এক সময় ছিল বিত্তবান পরিবারের ছেলেদের নেশার উপকরণ। এখন দাম কমে যাওয়ায় তা সাধারণের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। নিম্নবিত্ত বা সাধারণ পরিবারের ছেলেরাও ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে। মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। দিনে দিনে মাদক পরিস্থিতি জঙ্গীর চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
×