ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কঠোর নজরদারির পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের

করোনার নকল সুরক্ষা পণ্যে বাজার সয়লাব!

প্রকাশিত: ২১:৪২, ৪ জুলাই ২০২০

করোনার নকল সুরক্ষা পণ্যে বাজার সয়লাব!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে শুরু হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের ২১৫ দেশ ও অঞ্চলে ফণা তুলেছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচার চেষ্টা সবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধের উপায় হলো বারবার সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড করে হাত ধোয়া, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এই সুযোগে দেশে বেড়েছে সুরক্ষা সামগ্রীর দাম। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনগুণ বা চারগুণ পর্যন্ত বেড়েছে জীবাণুনাশক ও সুরক্ষা পণ্যের মূল্য। যেমন ইচ্ছে চলছে বেচাকেনা। তেমনি নকল পণ্যে সয়লাব বাজার। করোনার কারণে যখন মানুষের প্রাত্যহিক চাহিদা মেটানো দায় তখন সুরক্ষা সামগ্রীর বাড়তি দাম, মরার ওপর খাড়ার ঘায়ে রূপ নিয়েছে। সেইসঙ্গে নকল মানহীন পণ্যে মানুষের শরীরে নানা রকম রোগ ব্যাধি দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরাও। সুরক্ষা পণ্য বিক্রিতে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ সব পক্ষ থেকেই। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো মাস্ক পর্যন্ত নকল হয়েছে। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় আট মার্চ। প্রায় চার মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৩ হাজারের বেশি। মূল কথা হলো সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকেই বেড়ে চলেছে জীবাণুনাশক ও সুরক্ষা পণ্যের চাহিদা। এখন যেখানে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে এসব পণ্য। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বলছে, চাহিদা অনুযায়ী তারা বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে। আর এ সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নকল জীবাণুনাশক পণ্যে। আবার চাহিদা এত বেড়েছে ৪/৫ গুণ বেশি দামে বিক্রির অভিযোগও এসেছে এবং কয়েকটি জায়গায় এমন বেশি দামের কারণে ব্যবসায়ীদের জরিমানাও গুনতে হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায়। এক পর্যায়ে ওসুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে সাত কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম পর্যন্ত বেঁধে দিতে হয়েছে। তারপরেও এখনও অনেক জায়গায় অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে স্যাভলন কিংবা সেপনিলের মতো জীবাণুনাশক লিকুইডের বোতল। লেবেল ছাড়া নাম সর্বস্ব কোম্পানির পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেদার। একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জীবাণুনাশক সাবানসহ সব ধরনের পণ্যের বার্ষিক বাজার সর্বোচ্চ পাঁচ শ’ কোটি টাকার মতো ছিল, যা এবার বছর শেষ ৫-৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে ধারণা করছেন তারা। নগরীর বাসিন্দাদের অনেকে বলছেন, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে হেক্সাসল ব্র্যান্ডের দুটি ৫০ মিলিলিটারের বোতল কিনতে হয় আড়াই শ’ টাকায়, যদিও তার প্রকৃত মূল ছিল ৪০ টাকা করে মোট ৮০ টাকা। রাসেল নামের একজন জানালেন, এখন তো সুরক্ষা সামগ্রী পথে ঘাটে মেলে। তিনি বলেন, আগে একটি প্লাস্টিকের স্প্রে মেশিন বিক্রি হতো ২০ টাকায়। এখন ৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ছোট বোতলসহ কিনলে ১০০ টাকা গুনতে হয়। খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা শফিকুর রহমান শহীদ জানান, ঘরে জীবাণু ধ্বংসের জন্য বোতলে ব্লিচিং পাউডার গুলে স্প্রে করতে হয়। কিন্তু চোখের সামনে ২০ টাকার বোতল হলো ৪০ টাকা। আর ২০ টাকার স্প্রে মেশিন হলো ৬০ টাকা। আহাম্মদবাগের বাসিন্দা নয়ন মিয়া জানালেন, বাসাবো বালুর মাঠে গিয়ে দেখি সেভলনের বোতল দেদার বিক্রি হচ্ছে। দোকানে এক লিটার সেভলনের যত দাম সেখানে অনেক কম। কাছে গিয়ে দেখি বোতলের লেবেলে আসল সেভলনের মনোগ্রাম দেয়া থাকলেও নামের কিছু ভিন্নতা আছে। অর্থাৎ নকল পণ্য। এছাড়াও ডেটলসহ অন্যান্য নকল জীবাণুনাশক পণ্য সবই আছে পাড়া মহল্লার দোকানে। তেমনি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের গায়ে কোন লেবেল নেই। অথচ সুরক্ষা সামগ্রী হিসেবে সবাই কিনছি। এছাড়াও জীবাণুনাশক লিকুইটের অভাব নেই বাজারে। কিন্তু এসবের মান দেখার কেউ নেই। তাছাড়া অনেকে চশমাও বিক্রি করছেন ইচ্ছেমতো দামে। ইস্কাটনের পিয়াস জানালেন, এসিআই কোম্পানির ক্লিন জেল চিকন টিউব দোকানে ৭০ টাকা বিক্রি হয়। বাইরে হুবুহু নকল এ রকম ক্লিন জেল ১২০ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, আগে ব্লিচিং পাউডার কিনতাম ৬০ টাকা কেজি। এখন আধা কেজি কিনতে হচ্ছে ১০০ টাকায়। মতিঝিলের রতন পন্ডিত জানালেন, আমরা অন্ধকারে থেকে সুরক্ষা সামগ্রী কিনছি। কে এন-৯৫ ফাইভ মাস্ক ১৫০ টাকা করে অনলাইন ও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কেনার পর প্রথম দিনেই বেল্ট ছিঁড়ে যায়। তাহলে আসলেই কি এগুলো আসল? জানলে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান জনকণ্ঠকে বলেন, সুরক্ষা সামগ্রী তো যেখানে সেখানে বিক্রির কথা নয়। নকল সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির খবর আমরাও শুনছি। সুরক্ষা পণ্যের মান ঠিক না থাকায় মানুষ যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি তা কোন কাজে আসছে না। উল্টো নকল স্যানিটাইজারের কারণে চর্ম রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া পণ্যের মান ঠিক না থাকলে তা কিনে কোন কাজে আসবে না। তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে সুরক্ষা সামগ্রীর শতভাগ মান নিশ্চিত করা জরুরী। নকল পণ্যের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তিনি। যেসব কোম্পানি জীবাণুনাশক পণ্য উৎপাদন করে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্কয়ার ও এসিআই। দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই বলছেন জীবাণুনাশক সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড রাব, জীবাণুনাশক লিকুইড এ্যান্টিসেপটিক, বেবি ওয়াইপসেরও মতো পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। শীর্ষস্থানীয় যেসব কোম্পানি জীবাণুনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে তার মধ্যে আছে স্কয়ার, এসিআই, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা, ক্লিনজেল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ও অপসোনিন। এর মধ্যে এসিআইয়ের স্যাভলন বা হেক্সাসল এবং স্কয়ারের সেপনিল স্যানিটাইজারের বিক্রি বেড়েছে কয়েক শ’ গুণ। স্কয়ার টয়লট্রিজের হেড অব মার্কেটিং জেসমিন জামান একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানান আগে যেটি তারা বছরে ১৫-২০ টন উৎপাদন ও বাজারজাত করতেন এখন সেই পণ্য প্রতিদিন ৬০-৭০ টন বাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, হ্যান্ডওয়াশের চাহিদা বেড়েছে ৪/৫ গুণ আর জীবাণুনাশক অন্য পণ্যগুলোর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। আমরা আসলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহও করতে পারছি না। কারণ কারখানা ও কাঁচামালের ব্যাপার আছে। তবে বাজার চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এসিআই কনজ্যুার ব্রান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলছেন তাদের স্যাভলন লিকুইড ও এন্টিসেপটিক ক্রিমের বাজার কোভিড-১৯ মহামারীর আগে ছিল ৩৪ কোটি টাকার মতো। আগে দরকার ছিল দশ লাখ মানুষের। এখন দরকার হচ্ছে ১৭ কোটি মানুষের। সুতরাং চাহিদাটা কেমন হয়েছে বুঝতেই পারছেন। এসিআই বলছে এ মুহূর্তে তাদের সাবান, স্যানিটাইজার, রাব, লিকুইড এন্টিসেপটিক, ওয়াইপস বাজারে আছে যেগুলো জীবাণুমুক্ত করণে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে মানুষ। আলমগীর বলছেন, করোনায় চাহিদা অনুযায়ী তারা সরবরাহ দিতে পারেননি। কারণ তারা আগে থেকেই এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে ধারণা করতে পারেননি। তাছাড়া লকডাউন ও ছুটির কারণে কন্টেনারসহ নানা উপকরণ পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার যেসব দেশ থেকে কাঁচামাল এনে থাকি সেসব দেশেও করোনা। ফলে কাঁচামাল সঙ্কট। তবে আমরা আশা করছি সামনের কয়েক সপ্তাহে উৎপাদন আরও বাড়াতে পারব আমরা। সঙ্কটের সুযোগে গড়ে উঠছে নকল পণ্যের বাজার সঙ্কটের সুযোগ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে নকল জীবাণুনাশক পণ্য। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির পণ্যের নামের সদৃশ্য নাম দিয়ে বিক্রি করার সময় অনেককে আটকও করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। মে মাসেই চাঁদপুরে একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে নকল স্যাভলনের মজুদ খুঁজে পায় পুলিশ এবং এ ঘটনায় আটক করা হয় কয়েকজনকে। চট্টগ্রাম, যশোরসহ অনেক জায়গাতে মাসজুড়েই নকল স্যানিটাইজারসহ নানা নিম্নমানের জীবাণুনাশক পণ্য বিক্রি হয়েছে ব্যাপক। এসিআই নিজেও তাদের পণ্যের নকল করার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। ঢাকাতেই গুলশানে দুটি ফার্মেসিকে নকল পণ্য রাখার দায়ে জরিমানাও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৩ এপ্রিল রাজধানীর একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল মাস্ক ও করোনা সরঞ্জাম জব্দ করেছে র‌্যাব। রাজধানীর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে এসব নকল মাস্ক ও করোনা সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। র‌্যাব জানায়, যেসব এন-৯৫ মাস্ক জব্দ করা হয়েছে সেগুলো আসল নয়। র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, যেসব সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে তৈরি করা হয়নি। নকল মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির অপরাধে ২২ জুন ঢাকার মোস্তফা কামাল নামের এক খুচরা ব্যবসায়ীকে এক বছর কারাদন্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে ১০ জুন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিউমার্কেটের ৪টি দোকানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছে। রাজধানীর পান্থপথে এএসএ ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ নকল গ্লাভস ও গাউন জব্দ করেছে র‌্যাব। এ সময় ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও গোডাউন সিলগালা করা হয়। বাংলা মোটরের জহুরা টাওয়ার থেকে এ্যাডভান্স বায়ো কেমিক্যাল (এবিসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান এন-৯৫ বলে নকল মাস্ক কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছিল। এছাড়া সেখানে এন-৯৫ ছাপ দেয়া অনেক মাস্কের খালি প্যাকেটও পাওয়া গেছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চীন থেকে নিম্নমানের মাস্ক এনে এন-৯৫ বলে বিক্রি করে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে।
×