ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

প্রকাশিত: ২১:১৭, ৪ জুলাই ২০২০

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে অতি তাৎপর্যময় পুণ্যতিথি। এ পুর্ণিমা তিথিতে তথাগত বুদ্ধের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে। বিশেষ করে রাজকুমার সিদ্ধার্থের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধী গ্রহণ, গৃহত্যাগ (মহাভিনিষ্কমণ), সারনাথের ঋষি পতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট ভগবান বুদ্ধের প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা, শ্রাবস্তীর গন্ডম্ব বৃক্ষমূলে যমক প্রতিহার্য্য ঋদ্ধি প্রদর্শন, মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনার জন্য তুষিত স্বর্গে গমন এবং ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস ব্রত আরম্ভ। তথাগত বুদ্ধের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে। তাই বৌদ্ধদের কাছে পূর্ণিমা আসে জীবনে পূর্ণতা সাধনের জন্য। তথাগত বুদ্ধ যেমন নিজ প্রচেষ্টায় জীবনে পূর্ণতা সাধন করে মহাবোধি বা আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, জগজ্জ্যোতি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হন, ঠিক তেমনিভাবে পূর্ণ চন্দ্রের মতো নিজের জীবনকে ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ লাভ করাই প্রতিটি বৌদ্ধদের আত্ম প্রচেষ্টা। তেমনি আষাঢ়ী পূর্ণিমাও বৌদ্ধের জীবনে বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করে বৌদ্ধদের কাছে অতি স্মরণীয় হয়ে আছে। আজ হতে আড়াই হাজার বছরেরও অধিক আগের ঘটনা। কপিলাবস্তু নগরে আষাঢ়ী পূর্ণিমা সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হতো। রাজন্তপুরেও পালিত হতো এ পুণ্যোৎসব। রাজা শুদ্ধোধনের মহিষী রাণী মহামায়া আষাঢ়ী পূর্ণিমার উপোসথ ব্রত অধিষ্ঠান করলেন। সে রাতে রাণী মহামায়া স্বপ্ন মগ্ন হয়ে দেখলেন চারদিকপাল দেবগণ এসে পালঙ্কসহ মায়াদেবীকে নিয়ে গেলেন হিমালয়ের পর্বতোপরি সুবিস্তৃত এক সমতল ভূমির ওপর। তখন তারা মহামায়াকে সুউচ্চ মহাশাল বৃক্ষতলে রেখে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিমায় এক প্রান্তে দাঁড়ালেন। তারপর মায়াদেবীকে তাদের মহিষীগণ এসে হিমালয়ের অনবতপ্ত হৃদে (মানস-সরোবর) স্নান করিয়ে দিব্য (স্বর্গীয়) বসন ভূষণ ও মাল্যগন্ধে সমলংকৃত করলেন। অনতিদূরে শোভা পাচ্ছিল এক রজতপর্বত। সেই পবর্তোপরি ছিল এক সুবর্ণ প্রাসাদ। চারদিকপাল দেবগণ মহারাজা পুনঃপালঙ্কসহ দেবীকে সেই প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে দিব্যশর্যায় শয়ন করালেন। তখন অদূরবর্তী সুবর্ণ পর্বত থেকে নেমে এসে উত্তর দিক থেকে অগ্রসর হয়ে রজতপর্বতে আরোহণ করল। রজত শুভ্রশুন্ডে একটি শ্বেতপদ্ম ধারণ করে অবলীলাক্রমে কবিবর মহাক্রোষ্ণনাদে সুবর্ণ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তৎপর ধীরে ধীরে তিন বার মাতৃশয্যা প্রদক্ষিণ করে তার দক্ষিণ পার্শ্বভেদ করে মাতৃজঠরে প্রবেশ করল। কিন্তু তা স্বপ্ন নয়। অলৌকিক বাস্তব ঘটনা; যা ঘটে গেল স্বপ্নাকারে। তখন চারদিকে দিব্য আভায় উদ্ভাসিত হলো। এ রূপে উত্তরাষাঢ়ী নক্ষত্রযোগে মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসিন্ধ গ্রহণ করলেন ভাবী বুদ্ধ বোধিস্বত্ব। সেই আষাঢ়ী পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতেই এ অলৌকিক স্বপ্ন দর্শনে ভীত হলেন না রাণী মায়াদেবী। যেন দিব্য এক পুলকে অভিভূত তিনি। পরদিন প্রত্যুষে দেবী রাজাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালেন। রাজা কালবিলম্ব না করে চৌষট্টি জন জ্যোতির্বিদ এনে স্বপ্নের ফল জানতে চাইলেন। বিপ্রগণ বললেন, মহারাজ চিন্তা করবেন না, আপনার মহিষী সন্তান সম্ভবা হয়েছেন। লাভ করবেন তিনি এক দেব দুর্লভ পুত্ররত্ন। তখন বসুন্ধরা হবে ধন্য। তিনিই সে মহামানব সিদ্ধার্থ রূপে জন্ম নিলেন রাজপরিবারে। সিদ্ধার্থ গৌতমের বয়স তখন ২৯ (ঊনত্রিশ), তখন তার যৌবন পরিপূর্ণ। ভরা যৌবনের মাদকতা তাঁর কাছে নেই। সর্বদা বৈরাগ্য চিন্তায় মনকে উদাসীন করে তোলে। এ অবস্থা দেখে রাজা শুদ্বোধন কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমকে সুন্দরী যশোধরার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ফিরে এলো সেই আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এ তিথিতেই সিদ্ধার্থ পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভোগ বিলাস, রাজ্য, ধন, সব কিছুকে তুচ্ছ মনে করে মহাভিনিক্রমণ অর্থাৎ সংসার ত্যাগ করলেন। সমস্ত তৃষ্ণার বন্ধনকে ছিন্ন করে জগতের মুক্তির জন্য এ তাঁর আত্মত্যাগ। জগতের ইতিহাসে এরূপ আর কোন মহাপুরুষের জীবনে দৃষ্টান্ত নেই। ভোগের পৃথিবীতে এরূপ ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তা জীব-জগতের দুঃখ মোচনের জন্য। অতঃপর রাজকুমার গয়ার বোধিদ্রুম মূলে ০৬ (ছয়) বছর কঠোর সাধনার পর চরম ও পরম জ্ঞান ‘মহাবোধি’ লাভ করলেন। সম্যক সম্বুদ্ধ হিসেবে দেবমানবকে প্রজ্ঞার আলো বিতরণের তাঁর আবির্ভাব। বুদ্ধত্ব লাভের পর তথাগত (সম্যক সম্বুদ্ধ) চিন্তা করতে লাগলেন তাঁর নবলব্ধ ধর্ম সর্বপ্রথম কার কাছে প্রকাশ করবেন। সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহ-ত্যাগের পর প্রথম সাক্ষাৎ পান ঋষি আড়ার কালামের। সেই ঋষি আড়ার কালামের কথা চিন্তা করতেই দিব্যজ্ঞানে দেখেন তিনি পরলোকগমন করেছেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎপ্রার্থী রামপুত্র রুদ্রকের কথা স্মরণ করে জানতে পারেন তিনি পরপারের যাত্রী হয়েছেন। কাকে তাঁর প্রথম নবলব্ধ ধর্ম প্রকাশ করবেন সেই চিন্তা করতে গিয়ে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের কথা মনে পড়ল। তখন তিনি সারানাথের ঈষিপত্তন মৃগদাবে গমন করলেন। এই পঞ্চবর্গীয় শিষ্য তাঁর ধ্যানের সঙ্গী ছিলেন। সিদ্ধার্থ কৃচ্ছ্রসাধনা ত্যাগ করে মধ্যমপথ গ্রহণ করলে তারা তাকে ত্যাগ করে চলে যান। তথাগত বুদ্ধ সেই আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে ঈষি-পত্তন মৃগদাবে সেই পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে সর্বপ্রথম ধর্ম দেশনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ দেশনা করলেন। তাঁর নবলব্ধ সদ্ধর্মকে প্রকাশ করলেন। তিনি সেই ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রে’ বললেন- ‘হে ভিক্ষুগণ, দুটির চরমে প্রব্রজিত ভিক্ষু শ্রামণদের যাওয়া উচিত নহে। সেই দুটি কী কী? প্রথমত হীন গ্রাম্য ও সাধারণ জনসেবিত অনার্য ও অনর্থকর কাম্যবস্তুতে অনুরক্ত হওয়া আর দ্বিতীয়ত অনার্য ও অনর্থযুক্ত আত্মক্লেশজনিত দুঃখবরণ। এই দুই অন্ত ত্যাগ করে তথাগত মধ্যমপথ অধিগত হয়েছে, যা চক্ষু উৎপাদনকারী এবং যা মানুষকে সম্বোধি বা নিবাণের দিকে সংবর্তিত করে।’ ভগবান বুদ্ধের এ মধ্যমপথের শিক্ষা হলো- আর্যসত্যসমূহের দর্শন লাভ। সংসার দুঃখকে অতিক্রম হেতু যে মার্গ দর্শন। মার্গজ্ঞান ক্ষণেই চার আর্যসত্য প্রত্যক্ষ করেন। তা সংসার দুঃখ বিনাসের হেতু। সংযুক্ত নিকায়ের সচ্চ সংযুক্ত তৃতীয় বর্গে বলা হয়েছে- ’যারা দুঃখ, দুঃখোৎপত্তি, দুঃখ নিরোধ এবং দুঃখ নিরোধের মার্গ চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি জানেন না, তারা জন্ম, জরাদির অধীন এবং তারা দুখের অন্তসাধন করতে সক্ষম। যারা উক্ত আর্যসত্য জানেন, জন্ম, জরাদির অধীন না হয়ে সর্বদুঃখের অন্তসাধন করতে সক্ষম।’ ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্দেশে বলেছেন- ‘ভিক্ষুগণ! চারি আর্য সত্যের অনুরোধ ও পটিবোধের অভাবে আমাকেও তোমাদিগকে দীর্ঘকাল জন্ম হতে জন্মান্তরে এবং ভব হতে ভবান্তরে সন্ধাবন ও সংসরণ করতে হয়েছে। ভিক্ষুগণ! সে চার আর্যসত্য বর্তমানে অনুবুদ্ধ ও পটিবিদ্ধ হয়েছে। এখন ভবতৃঞ্চা উচ্ছিন্ন হয়েছে, ভবরজ্জু ক্ষীণ হয়েছে। আর পুনর্জন্ম নেই।’ সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির সপ্তম বছর পর আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসে শ্রাবস্তীর নগরদ্বারে গন্ডম্ব বৃক্ষমূলে যমক প্রতিহার্য ঋদ্ধি প্রদর্শন করে। অতঃপর ঋদ্ধি প্রদর্শন করে ক্রমে ত্রিপদ বিক্ষেপে তাবতিংশ দেবলোকে উপস্থিত হয়েছিলেন। তথায় তিনি অভিধর্ম দেশনা করার মানসে পারিজাত বৃক্ষমূলে পান্ডুকম্বল শিলাসনে উপবেশন করলেন। দশ সহস্র চক্রবালের দেব-ব্রহ্ম তখন বুদ্ধ সন্নিধানে সম্মিলিত হলেন। বুদ্ধের অনুপম ষড়শ্মি দেবব্রহ্মের দিব্য জ্যোতিকেও অভিহিত করল। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা পুণ্য তিথিতেই তথাগত বুদ্ধ তাবতিংশ স্বর্গে বর্ষাবাস গ্রহণ করেছিলেন। এ বর্ষাবাসের কারণ তাঁর মাতৃদেবীকে নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন করা। তাই এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ পূর্ণিমার মাহাত্ম্য বর্ণনা ব্যাপক। অনেক পুণ্যময় ও তাৎপর্যময় স্মৃতি বিজড়িত এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা। বাংলাদেশেরও অনুরূপভাবে এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর পরিবেশে প্রতিপালিত হয়ে এসেছে। আজ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস আরম্ভ। বর্তমান এমন সময়ে শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমাগত পুরো পৃথিবীর মানুষ মরণঘাতী কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাসের মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। পৃথিবীতে মানুষের জন্য এই বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ চায় গোটা পৃথিবীর মানবজাতি। এ করোনাভাইরাস আমাদের সকলকে মানবিক হতে শিক্ষা দিচ্ছে। ভগবান বুদ্ধের মতো আত্মত্যাগী হয়ে এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে মানবজাতিকে রক্ষা যত্নবান হই। বিশ্ব মানবতা সভ্যতার অনন্য পুণ্যময় তিথিকে স্মরণ করে আত্মসংযম করে সবাই নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন হোক- এই প্রত্যাশা। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশন ও সম্পাদক, সৌগত
×