ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২২:০০, ৩ জুলাই ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

অঘোষিত লকডাউন তুলে নেয়ায় ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষেরা এখন কিছুটা ভাল আছেন। জীবন ও জীবিকা নিয়ে হঠাৎই মারাত্মক অনিশ্চয়তা পড়ে গিয়েছিলেন তারা। হাতে কাজ ছিল না। আর কাজ নেই মানে উপার্জন নেই। জমানো টাকা থাকার তো প্রশ্নই আসে না। মহা অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসছিল। ঠিক তখন সাধারণ ছুটি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অঘোষিত লকডাউন তুলে নেয়া হয়। সীমিত পরিসরে চালু হয় সবকিছু। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে। বর্তমানে রিক্সা ভ্যান ঠেলাগাড়ি চালক, সবজি ফলমূল বিক্রেতা, ফুটপাথের দোকানি, হকার, চা বিক্রেতা, নির্মাণ শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি পুরোদমে কাজে ফিরেছেন। চারপাশে তাকালে এমন অনেক দৃশ্য চোখে পড়ছে। তেজগাঁওয়ে হলিক্রস কলেজের সামনের ফুটপাথে নতুন করে বসেছে সবজি ও ফলমূলের বাজার। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বিক্রেতার সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কিছু দূর পরপর একটি দোকান। দোকান মানে, ফুটপাথে পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর আলু কাঁচামরিচ বেগুন লেবু পেঁয়াজ রসুন ইত্যাদি নিয়ে বসেছেন। কেউ কেউ বিক্রি করছেন মৌসুমি ফল। গাজী নামের মধ্যবয়স্ক এক বিক্রেতা বলছিলেন, ‘করোনার আগে কাওরান বাজারে আনাজ বিক্রি করতাম। কাস্টমারগো ভিড় অয়। তাই এখন আর বইতে দেয় না। কলেজ বন্ধ। কলেজের সামনে জায়গা দিসে।’ বিক্রি অতো ভাল না জানালেও তিনি বলেন, ‘জীবনটা তো বাঁচাইতে পারতাসি। বাসায় পোলা মাইয়া বউ আছে। মা আছে। মোট ছয় জন। সবাইরে খাওয়াইতে হয়। মাঝে সব কিছু বন্ধ করে দেয়ায় বাড়িতে বইসা থাকতে হইছে। তিন বেলা খামু, টেকা কই? ধার দেনা করারও লোক পাই নাই। এখন টুকটাক যা বিক্রি হয়, ধরেন, চলে। না খাইয়া থাকতে হইতাছে না।’ মানিক মিয়া এভিনিউতে কথা হয় এক নারী শ্রমিকের সঙ্গে। রাস্তার পাশের ড্রেন সংস্কার করা হচ্ছে। সেখানে কাজ করেন তিনি। পুরুষের পাশাপাশি মাথায় ইট বহন করছিলেন। এক ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। নাম জুবেদা। সবাই যখন ঘরে তখন আপনি বাইরে, অন্যদের সঙ্গে মিশছেন, কাজ করছেন, করোনা সংক্রমণের ভয় কাজ করে না? জানতে চাইলে একটা সরল হাসি হেসে তিনি বলেন, ‘এই কাজটা পাইসিলাম করোনার আগে। মাঝখানে বন্ধ হইয়া গেছিল। দিনে একবার খাইয়া বাঁচতে হইছে। কেউ খাওন দিসে? দিব? এখন কাজ শুরু হইছে। যেদিন কাজ করি সেদিনই টেকা পাই। এই টেকা দিয়া চলতাসি।’ নিজের চেনা জানা অনেকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে অনেক দিন চলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কাজ কইরা খামু। আমরা গরিবরে অসুখে ধরবো না।’ আসলেই ধরবে না, না, এমন কথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। তবে খেটে খাওয়া মানুষের এমন সংগ্রামী জীবন আত্মবিশ্বাস দেখে অভিভূত হতে হয়। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। অবশ্য রাজধানীর মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি এখনও ভুগছে। করোনা সংক্রমণ ছাড়াও নানা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ বন্ধ। আয় রোজগার নেই। কারও কারও আবার বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কোন রকমে খেয়ে বাঁচতে পারছে হয়ত, বিপদে পড়ছে বাসা ভাড়া নিয়ে। ঢাকার জীবনে খরচের একটি বড় খাত নিঃসন্দেহে বাসাভাড়া। সীমিত আয়ের মানুষেরাই মূলত বাসা ভাড়া করে বসবাস করেন। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মহা বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা। এ পর্যায়ে যেন আর পেরে উঠছেন না। আর তাই জুলাই মাসে বহু মানুষ বাসা ছেড়ে গেছেন। এখনও অনেক বাসা বাড়ি খালি হতে দেখা যাচ্ছে। আসবাব ও অন্যান্য মালামাল বহনকারী ভ্যান ঘন ঘন চোখে পড়ছে। কোথায় যাচ্ছে এসব মালামাল? সংশ্লিষ্টরা সহজে মুখ খুলতে চান না। তবে দু’একজন স্বীকার করে বলেছেন, ভাড়ার টাকা দিতে না পেরে বাসা ছেড়ে যাচ্ছেন তারা। কেউ গ্রামে ফিরছেন। কেউ আগের চেয়ে কম টাকার বাসায় উঠছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। টিউশনি নেই। মেসের ভাড়া মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ছাত্ররাও। তারাও গ্রামের পথ ধরছে। আগেই অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সরকারের সাধারণ ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরেছিলেন। আয় রোজগারের আশায় ছিলেন। কিন্তু কত আর পারা যায়? অগত্যা গ্রামে ফিরছে তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, দুইটা ছেলে মেয়ে পড়াতাম আমি। যা পেতাম বেশ চলে যেত। ছাদে একা একটা রুম ভাড়া করে থাকতাম। গত এপ্রিল থেকে দুটো টিউশনিই বন্ধ। প্রথম দুই মাস ছাত্র না পড়ালেও, আমাকে অভিভাবকরা বেতন দিয়েছেন। এখন নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগে। তাই জুন মাসে আর টাকা নিইনি। বাড়ি থেকে টাকা এনে বাসাভাড়া মিটিয়েছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই গ্রামে ফিরে যাবেন বলে জানান এ শিক্ষার্থী। এদিকে এ পরিস্থিতির মধ্যেই আসছে কোরবানির ঈদ। প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীতে যথারীতি বসছে পশুর হাট। এবার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হাট বসবে না। আগে যেসব দরপত্র আহ্বান করা হয়ছিল সেগুলো বাতিল করা হয়েছ। নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে সব কিছু। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন করে হাট ইজারা দেবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো? অনেক বড় প্রশ্ন। উত্তর, বলার অপেক্ষা রাখে না, সময় দেবে।
×