ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহীউদ্দীন খান আলমগীর

জীবনাশ্রয়ী নৃত্যকলা- ফ্লামেঙ্কো

প্রকাশিত: ২১:০৫, ৩ জুলাই ২০২০

জীবনাশ্রয়ী নৃত্যকলা- ফ্লামেঙ্কো

ফ্লামেঙ্কো হলো স্পেনের আন্দালুসিয়া এলাকায় জন্ম নেয়া এক ধরনের লোকজ নাচ। এ নাচ গড়ে উঠেছে শতাব্দী ধরে আন্দালুসিয়ার আদি অধিবাসী, জিপসী রোমানী ও ঐ এলাকার পশু পালক ইহুদীদের দিয়ে। অনেক আগে ১৭৭৪ সালেও ফ্লামেঙ্কো বাদন ও নাচের প্রচলন ছিল স্পেনের এই এলাকায়। বাদনসহ এ নাচ এই সময় যেমন স্পেনে বহুল চর্চিত, তেমনি এর জনপ্রিয়তা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ও জাপানে, বাড়ছে লাতিন আমেরিকায়। তবে ফ্লামেঙ্কো নাচ শেখার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক একাডেমি বিদ্যমান স্পেনে নয়, জাপানে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে ফ্লামেঙ্কোর নিরন্তর চর্চা এই যুগের নাচ পটিয়সীদের আকর্ষণ। সম্ভবত ১৮ শতাব্দীতে স্পেন থেকে বেশ সংখ্যক অধিবাসী এই এলাকায় বাস গেড়েছিল বলে এই এলাকায় এই নাচের এরূপ প্রচলন ও আকর্ষণ ঘটেছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মাদ্রিদে একটি ছোট অথচ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত নামকরা মিলনায়তন ফ্লামেঙ্কো ডি মাদ্রিদে এই নাচ স্ত্রী সিতারাসহ দেখতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল আমাদের ছেলে জয় ও বৌমা হিমি। মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থানে পুরনো পাথরগাড়া উঁচু নিচু রাস্তা হেঁটে খুঁজে পেয়েছিলাম ৫০-৬০ আসনের সেই ছোট মিলনায়তনটি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে টিকিট কাটা হয়েছিল মাসখানেক আগে। শুনেছিলাম চট করে বা তাৎক্ষণিকভাবে এই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ফ্লামেঙ্কো নাচ দেখার টিকেট পাওয়া কঠিন। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় শুরু হয়েছিল সেই ফ্লামেঙ্কো। আমাদের সামনে কাঠের মঞ্চের উপরে উজ্জ্বল বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অবিন্যস্ত চুলসহ একজন পুরুষ স্পেনীয় গিটার হাতে এক চেয়ার নিয়ে বসলেন তার নিচে। তার গিটারে লোকগীতির সুর বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তেমনি কোকরানো চুলসহ সাধারণ পোশাক পরা এক গায়ক এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে তার পাশে। বাউলী সুরে স্পেনীয় ভাষায় তিনি গেয়ে উঠলেন আর তার সঙ্গে সুর মেলালেন গিটার বাদক। দুপদ গাওয়া ও বাজানোর পর দুরন্ত বেগে প্রবেশ করলেন সুদেহী দুই নারী নৃত্য শিল্পী। পরনে তাদের লোকজ ফুল আঁকা ডোরাকাটা হাঁটু ছড়ানো সাদামাটা পোশাক। কপাল থেকে পিঠে ছড়ানো প্রাচ্যদেশীয় সিথি কাটা নেমে আসা কালো চুল, সিঁথির সামনে ঝোলানো সোনালী টিকলী। গান আর গিটারের তালে তালে দুই পর্যায়ে বাউলী কলায় নাচলেন তারা। দুই পর্যায়েই নাচের শেষ ছন্দে দুমকি চালের শব্দে দর্শকদের চমকিয়ে কাঠ-নির্মিত মঞ্চে সশব্দে পদ চারণ করে থমকে উঠলেন যেন তারা। তাদের লীলায়িত হাত, অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল কোমড় এবং অদম্য শক্তিশালী পদচারণা ফুটিয়ে তুলল, যেন কোন লক্ষ্য অর্জনে তাদের দৃঢ় সংকল্পবোধ কিংবা কোন দৃষ্ট অনাচার বা অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। আন্দালুসিয়ায় জিপসী রোমানীয়দের সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুগযুগ ধরে অহর্নিশি সংগ্রাম এরূপ সংকল্পবোধ বা প্রতিবাদের বহির্প্রকাশ বা প্রতিফলনের জন্ম দিয়েছে বলে বলা হয়। এও বলা হয় যে তখনকার জিপসী রোমানীয়দের সঙ্গে বহিষ্কৃত মুসলিম কৃষক কূল তাদের প্রতিবাদের ভাষা ও প্রতিফলক হিসেবে হিস্পনীয়- আরবীয় শব্দে উচ্চারিত ‘ফেন্নামিংগো’ নামে তাদের সংকল্পবোধ ও প্রতিবাদের প্রতিফলক হিসেবে পরববর্তী কালের ফ্লামেঙ্কো নাচের জন্ম দেয়। প্রতিফলিত এই দৃঢ় সংকল্পবোধ বা প্রতিবাদ সুস্পষ্টভাবে নির্যাতন, অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে কিংবা সকল বাঁধা ব্যত্যয় ছাড়িয়ে তাদের সামনে যাওয়ার দ্যোতক হিসাবে প্রতিফলিত হলো আমাদের কাছে। নাচের সঙ্গে গীত গান ঐ ধরনের সংকল্পবোধ বা প্রতিবাদের ঐতিহ্যবাহী কাহিনীর কথা তুলে ধরল আর গীটারের বাদন তাকে বাউলী ¯িœগ্ধতার সমর্থন দিয়ে অভিষিক্ত করে চলল যেন। আমাদের বলা হলো এই সেই যুগ যুগ ধরে লালিত ফ্লামেঙ্কো নাচ। এও বলা হল যে, সম্প্রতিককালে জাপান ও নিউ মেক্সিকোয় এ ধরনের নাচে অংশত পরবর্তী কালের বাদন ও ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। স্পেনিশ ভাষায় ফ্লামেঙ্কো-এর অর্থ কিংবা দ্যোতক হলো আগুন বা অগ্নিশিখা। সেই প্রেক্ষিতে ফ্লামেঙ্কোর নাচ নাচিয়েদের মাধ্যমে সমাজের আগুনে আচরণ, সংকল্পবোধ কিংবা প্রতিবাদ অববায়িত ও প্রতিভাত করে। ক্রমাগতভাবে বেড়ে ওঠা জনপ্রিয়তার পটে এই বিবেচনায় ২০১০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংঘ বা ইউনেসকো ফ্লামেঙ্কো নাচকে মানবতার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফ্লামেঙ্কো নাচ প্রথাগতভাবে কতিপয় পালস বা কান্টেসে ভাগ করে নৃত্যায়িত ও প্রদর্শিত হয়। ছন্দের ছাঁচ, ধরন, ধুয়া, একতান, স্তবক এবং নাচে প্রতিফলিত কথা বা কাহিনীর ভৌগোলিক উৎসারণ নাচের ও বাজনার ধরন বা বিন্যাস নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ থেকে আগত বাদামী বর্ণের দর্শক হিসেবে মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা আমাদের সবাইকে সামনের সারিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন বলে আমরা এই নাচের ধরন বা বিন্যাস ধরতে পেরেছি। আমাদের ধারণা, বাদন ও গানের বিন্যাসে সমকালে পৃথিবী জুড়ে যে প্রযুক্তি ও দর্শনের ভুক্তি ঘটছে, তা এই নাচকে তার প্রথাগত উপস্থাপন কলার পরিবর্তন ঘটাবে। স্পেনের ফ্লামেঙ্কো নাচ রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী বলশয় থিয়েটায়ের ব্যালে নাচের আপেক্ষিকতায় সুবিন্যস্ত নয়। ১৯৮১ সালে মস্কোয় বলশয় থিয়েটারের অবিস্মরণীয় ব্যালে ‘রাজহংসের হ্রদ’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তেমনি একই সালে সেই নগরেই দেখেছিলাম চায়কোভঙ্কির ‘ঘুমন্ত সুন্দরী’। প্রায় ১০ বছর পরে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সাগরের ঢেউ ছোঁয়া সিডনির অপেরা হাউসে দেখেছিলাম অস্ট্রেলীয় ব্যালে দলের উপস্থাপিত কোপেলিয়া। এসব ব্যালে ফ্লামেঙ্কোর তুলনায় দীর্ঘ, স্পষ্টতর এবং সংবেদনশীল প্রেম ও হৃদ্যতার কাহিনী। উপস্থাপনায় মনে হয়েছে নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গের শিল্পীরা বায়ুতে ভর করে শারীরিক কলার দ্যোতনায় দর্শকদের সন্মেহিত করছেন। এসব উপস্থাপনা কাল প্রেক্ষিতে অধিকতর প্রযুক্তি, মনোগ্রাহী বাদনভিত্তিক এবং অপেক্ষাকৃত বিস্তৃতির কাহিনী বা ভাবধারার দ্যোতক। ১৯৮৫ তে দেখেছিলাম অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ফিলহারমোনিক বা কলা সম্মিলনীতে সেখানকার অর্কেস্ট্রায় প্রাণে স্পন্দন জাগানো মাহলারের নবম সিম্ফনী। এ ধরনের উপস্থাপনা বাদন প্রধান, প্রযুক্তিক বিভিন্নতায় সমুজ্জ্বল এবং এসবে নাচ আনুষঙ্গিক হলেও দর্শক শ্রোতাদের অংশগ্রহণে আবেদনমুখী। তেমনি দেখেছিলাম তিন দশক আগে প্রথম এবং তারপরে বেশ কয়েকবার প্যারিসের সাঁজেলিজের কয়েকটি থিয়েটারে ফরাসী শিল্পীদের বহু যন্ত্রাদি উৎসারিত মোহময়ী বাজনার পটে নারী পুরুষের সংবেদনশীল ও মিলনাশ্রয়ী অংশগ্রহণমূলক নৃত্যের অনুপম উপস্থাপনা। আরেক সময়ে দেখেছিলাম সেই নগরীর গার্নিয়ার প্রাসাদে প্রায় ২০০০ দর্শকের সঙ্গে বসে ইউরোপীয় নাচ গানের সন্মোহনী প্রদর্শনী। গার্নিয়ারের মঞ্চ সম্ভবত পৃথিবীর বৃহত্তম, এক সঙ্গে ৪৫০ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই মাপের বিস্তৃত অংশগ্রহণ এসব মঞ্চে উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত নাচ গানের প্রসারী জনপ্রিয়তার প্রতিফলক। মনে পড়ে এই নগরীর আরেক প্রখ্যাত নাট্যসালা মলিনরুজকে কেন্দ্র করে একই নামে পৃথিবীখ্যাত এক হৃদয়স্পর্শী গানবাদন সমৃদ্ধ ছায়াছবি নির্মিত হয়েছিল ২০০১-এ। এতে অভিনয় করার জন্য সর্বোত্তম অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন টম ক্রুজের সাথী চির যুবতী নিকল কিডম্যান। রাশিয়ার বলশয় কিংবা চায়কভস্কি থিয়েটারে পরিবেশিত ব্যালে মাদ্রিদের ফ্লামেঙ্কোর তুলনায় অনেক পরিশীলিত, দীর্ঘ ও দীপ্যমান কাহিনীর প্রতিফলক। সিডনি অপেরায় ঐ সময়ে ঐ মহাদেশেও মনকাড়ানো কোপেলিয়ার উপস্থাপনা তেমনি দীর্ঘ, সুস্পষ্ট ও সংবেদনশীল। ভিয়েনার ফিলহারমনিক শত বছর ধরে বহুবিধ প্রযুক্তি উৎসারিত বাজনার বাদনের মোহময়ী অপার্থিব উপস্থাপনার দাবিদার। প্যারিসের নাচ, গান অভিনয় কালপ্রেক্ষিতে সর্বহৃদয়গ্রাহী অনুভূতি, উপলব্ধি ও দ্যোতনা সৃষ্টি করে। সেই তুলনায় স্পেনের বা মাদ্রিদের ফ্লামেঙ্কো নাচ আঞ্চলিক, প্রযুক্তিতে পশ্চাদপদ, খানিকটা নিষ্প্রভ এবং স্বল্পমেয়াদী কাহিনীর রূপকার। কিন্তু লোকজ সংস্কৃতির প্রতিফলক হিসেবে ফ্লামেঙ্কো যুগান্তরিক ধীরজ বিবর্তন সত্ত্বেও ওসবের তুলনায় এক্ষেত্রে নিশ্চিত হৃদয়গ্রাহী বলে আমাদের ধারণা। বার্লিনের রাষ্ট্রীয় অপেরা প্রধানত বাদনের মনসের পীঠস্থান। দুই জার্মানির একীভূত হওয়া এবং বার্লিন দেয়াল নামিয়ে আনার পরে ১০০০ আসনের এই অপেরা ইউরোপের সবচেয়ে নামকরা বাদনের নিলয় বলে স্বীকৃতি পেতে চলছে। এখানেও একবার দেখেছিলাম ও শুনেছিলাম মোর্জাটের সুরলিপির মূর্ছনা। লন্ডনের ওয়েস্ট এ্যান্ড এলাকার নাট্যশালাগুলোও পৃথিবীখ্যাত। এখানেও কয়েকবার শেক্সপিয়ার ও বার্নাড শয়ের নাটক দেখতে পেরেছিলাম। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট এ্যান্ড এলাকার নাট্যশালাগুলোতে ১ কোটি ৫৫ লাখ দর্শক নাট্যকলা উপভোগ করেছেন বলে বিদিত হয়েছে। এর তুলনায় এভন নদীর পারের শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান স্টাফর্ডে সারা বছর ধরে উপস্থাপিত তার নাটকগুলোয় দর্শকের উপস্থিতি কম। স্টাফর্ডের কয়েকটি নাট্যশালায় শেক্সপিয়ারের উপস্থাপনা শৈলীর বিচারে আমাদের হতাশ করেছে বলতে পারি। ১৯৯০এর দশকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ব্রডওয়েতে অবস্থিত ৪১টি নাট্যশালার কয়েকটিতে বাজনা ও নাচ সমৃদ্ধ নাটক দেখেছিলাম কয়েকবার। এসব নাট্যশালার প্রতিটিতে ৫০০ আসনজুড়ে ইংরেজী ভাষী নারী পুরুষ প্রায় প্রতিদিন নাটক বা নৃত্যকলা দেখেন। এখানে উপস্থাপিত অনেক নাটক পরবর্তী সময়ে হলিউডের ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ১ কোটি ৪৭ লাখ দর্শক ব্রডওয়ের বিভিন্ন নাট্যশালায় নাটক, বাদন ও গানের উপস্থাপনা উপভোগ করেছেন বলে জানা গেছে। এই সংখ্যার দর্শকদের উপস্থিতি এসব নাটক ও নাচের বিস্তৃত জনপ্রিয়তার প্রতিফলক। মনে পড়ে এখানকার এক নাট্যশালা- সম্ভবত, লিংকন সেন্টারে- এক নাটক দেখাকালীন সন্ধ্যায় আমি ও সিতারা আমাদের কয়েক সাড়ি সামনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারীকে প্রহরী বেষ্টিতভাবে উপবিষ্ট দেখেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে নগরকেন্দ্রিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্কৃতির দীপ্যমান বিদ্যমানতা সত্ত্বেও দেশজ গান উপস্থাপনা, উদাহরণত জনী ক্যাশ ও কেনী রজার্সের গায়কী আমাদের মুগ্ধ করেছে। এর বিপরীতে লোহিত ভারতীয় বামূল আমেরিকানদের নৃত্য, গান, প্রযুক্তির অনুপস্থিতি ও তাদের অমানবিক আবাসবদ্ধতার কারণে সামনে এগিয়ে আসতে পারছে না বলেই আমাদের ধারণা। ১৯৮০ এর দশকে দুবার ইন্দোনেশিয়ার বালিতে হিন্দুদের পূরণ কাহিনীভিত্তিক নাচ দেখেছি। প্রকৃতির প্রচ্ছায়ে নান্দনিক পোশাকে আবৃতা নারীদের এসব দলগত নাচ চোখ ও মনে লাগে। তথাপি মনে হয় পুরনো কাহিনীর আবর্ত কিংবা অচলায়িত প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে তাদের উপস্থাপনা মুক্ত নয়। সেজন্য সম্ভবত বৈচিত্র্যবিহীনতার কারণে বালির নাচ প্যারিসের সদা পরিবর্তনশীল উপস্থাপনা, ব্রডওয়ের প্রযুক্তি ও আধুনিক মানসিকতার প্রতিফলক এমনকি ফ্লামেঙ্কোর অপেক্ষাকৃত ধীরজ কিন্তু অস্থবির দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপন শৈলীর সঙ্গে তাল মিলাতে সমর্থ হবে না। বৈচিত্র্যহীনতা ও আধুনিক বাদন বহির্ভূত ভারতের বিভিন্ন মন্দির কেন্দ্রিক নাচ একই কারণ ও বিবেচনায় তেমনি যুগের বিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না বলেই মনে হয়। ভারতের প্রধান নগরসমূহের প্রেক্ষাগৃহে কিংবা বহুল প্রদর্শিত রুপালি পর্দায় পূরনো কালের এসব লোকজ নাচ-গান-বাদন সমকালে স্থান পাচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে। স্পেনের লোকজ নাচ ফ্লামেঙ্কোর সঙ্গে আমাদের দেশের চট্টগ্রামের উপজাতীয় এলাকার চাকমা ও গারোদের, নেত্রকোনা ও নওগাঁ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রান্তসীমার সাঁওতালদের নাচের তুলনা করা যায়। ফ্লামেঙ্কোর তুলনায় আমাদেও দেশের এসব নাচে নারীর অংশগ্রহণ বেশি, রীতি, ছন্দ, কাহিনী ও গায়কীতে পূরনো গাঁথা, ভাব ও ভঙ্গিও আধিক্যে এক ঘেয়ে। এসব নাচে যুগান্তরিক প্রযুক্তি যেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি, তেমনি সমাজ মানসের বিবর্তন আশানুরূপ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে নওগাঁয় থাকাকালীন সময়ে সাঁওতালদেও নাচ যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনিই বিবর্তন বর্জিত অবয়বে দেখেছি এই দশকেও। সিলেট এলাকা এমনকি রাজধানী ঢাকায় মাঝে মাঝে উপস্থাপিত মনিপুরী নাচ রীতি, ছন্দ ও কাহিনীতে একঘেয়ে বলে জনপ্রিয়তার মাপে সমকালে পশ্চাদগামী। দেবদেবীর অর্চনার বাইরে এসব নৃত্যে সমকালীন মানুষের বিবর্তনীয় অনুভূতি ও উপলব্ধি স্থান পাচ্ছে না বলেই মনে হয়। যশোরের হরিণাকু- ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী এলাকার লালনগীতির চর্চা বা উপস্থাপনায় নাচের কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ১৯৭০ এর দশকে কর্মকালে ঐ এলাকায় বেশ কয়েকবার যাওয়া ও থাকাকালীন সময়ে এই এলাকার বাউলগান ও জীবনযাত্রা আমার কাছে স্থবির এমনকি পশ্চাৎগামী মনে হয়েছে। ১৯৭০-৮০ এর দশকে এদেশে লালনগীতির প্রখ্যাত গায়িকা ফরিদা পারভীনকে আমি এসব গীতির গায়কীর সঙ্গে লোকজ নাচের আধুনিক বাদনের বিশেষত স্পেনীয় গিটারের সংযুক্তির কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে লোকজ গীতি ও গায়কী উপস্থাপনায় যুগপোযোগী প্রযুক্তিকে ধরে জনমনে বিস্তৃতি লাভ করেছে। তিনি মৃদু হাসিতে নীরব থেকে সম্ভবত এই লক্ষ্যে তার অসমর্থনের কথা জানাতে চেয়েছেন। উপকূল ও চরাঞ্চল এলাকায় মাঝে মধ্যে দৃষ্ট বলি খেলা বা লাঠি খেলায় হাত ও পায়ের সংকল্পবদ্ধ চারণা এখনও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু কাহিনী বা কাহিনীর বৈচিত্র্য এবং আকর্ষণীয় বাদন বিবর্জিত বলে এসব জনপ্রিয়তার বিস্তৃতি পায়নি বলা চলে। এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও মানসিকতার বিবর্তন স্থান না বলে এসব আকর্ষণীয় লোকজ কলা হিসেবে হারিয়ে যাবে বলেই মনে হয়। কেবলমাত্র ঢাকার বেলি রোড কেন্দ্রিক নাট্যচর্চা ও প্রদর্শনী সমকালের প্রযুক্তি ও মানসিকতার বিবর্তন অংশত প্রতিফলিত করে যাচ্ছে বলা চলে। নিরন্তর চর্চা, বিবর্তন উন্মুখ মনোভাব ও প্রকাশ শৈলী, সমাজ লালিত বিস্তৃতিতে এসব নাটককে উন্মুক্ত করতে পারে। আমাদের শিল্পকলা একাডেমি এক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে অধিকতর দৃষ্টি দিলে তা দেশের সৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের পথ ধরে বাইরের জগতের মনোযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার বলয়ে স্থান পেতে পারে। লেখক : এমপি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
×