ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আমাদের সংস্কৃতিতে কোরবানির ঈদ

প্রকাশিত: ২০:০২, ৩ জুলাই ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আমাদের সংস্কৃতিতে কোরবানির ঈদ

সংস্কৃতি বা তমদ্দুন একটি জাতির আত্মপরিচয়ের দর্পণ। বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি যেসব উপাদান দ্বারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে তার মধ্যে কোরবানির ঈদ বা ঈদ-উল-আজহা অন্যতম। মুসলিম দুনিয়ায় ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক স্থিরিকৃত ঈদ হিসেবে পালিত হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতগণ তার জন্মদিনকেও যে ঈদ হিসেবে পালন করে আসছে তাকে বলা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী। কোরবানির ঈদ বা ঈদ-উল-আজহা পালিত হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামের কোরবানির ঘটনার স্মারক হিসেবে। বাংলাদেশে ইসলাম যেদিন এসেছে সেদিন থেকেই ইসলামী অনুশাসন ও উৎসবাদী এ দেশের ইসলাম গ্রহণকারী সৌভাগ্যবান মানুষ পালন করে আসছে। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ তার মূল অনুশাসন বজায় রেখে আপন মহিমায় ভাস্বর, সেই সঙ্গে এর মধ্যে এক অনন্য রুচিনীতি বা সাংস্কৃতিক কাঠামো সংস্থাপিত হয়েছে, যা কোরবানির মূল অনুশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষ তো ঘটায়নি বরং তাকে সমুন্নত করেছে নতুন মাত্রায় আনন্দ সৌকর্য শোভিত করে। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহতে নিবেদিত প্রাণ হওয়া। আমার সালাত ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এই দৃঢ়প্রত্যয়ে বলীয়ান বাংলাদেশের মানুষ ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদকে পালন করে আসছে। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ আসার মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে কোরবানি দেয়ার জন্য পশু খরিদ করার। কোরবানির পশুরহাট শহরে-নগরে বিশেষ সাজে সজ্জিত হয়ে বসে। কোথাও কোথাও তো বিরাট বিরাট তোরণ নির্মাণ করে ও ঝালরযুক্ত শামিয়ানা টাঙিয়ে এবং আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ছাড়াও দেয়ালে দেয়ালে বিরাট বিরাট পোস্টারও টাঙানো হয়। ব্যানার, ফেস্টুন স্থাপন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর গলায় কাপড়ের ঝালর কিংবা ফুলের মালা পরানো হয়। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে তত পশু কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যে ঈদের আনন্দ যেন পশু খরিদের সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। সবার অজান্তে জাগ্রত হয়ে ওঠে মন গভীরে কোরবানির চেতনা। তবে একশ্রেণীর বড়লোকী দেখানোর মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ চড়া দামে পশু কিনে নাম জাহিরের যে চেষ্টা করে তা কোরবানির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় বরং কোরবানির উদ্দেশ্যটিকে বেশ কিছুটা ক্ষুণ্ণই করে। ঈদ-উল-ফিতরের পূর্বে নতুন পোশাকাদির প্রতি যেমন আকর্ষণ থাকে ঈদ-উল-আজহাতে তেমনটা আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় না, বরং সামর্থ্যবানরা কোরবানির পশু খরিদের উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যারা পশু খরিদ করতে অপারগ তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষও গোশতের ভাগ পাবেন এই আশা পোষণ করে ঈদের আনন্দকে লালন করেন। বাংলাদেশে গরু কিংবা ছাগল কোরবানি দেয়া হয়। তবে গরু কোরবানিই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেয়া হয়। এতে সুবিধাটা হচ্ছে সাতজন ভাগে এটা দেয়া যায়। গরু কোরবানির ঝোঁক বেশি থাকার আর একটি কারণ হচ্ছে- এই গরু কোরবানির কারণে এককালে এখানকার মুসলমানদের ভীষণভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে এবং শহীদও হতে হয়েছে। সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দ গরু কোরবানির অপরাধে সুফী বুরহানুদ্দীনের শিশু পুত্রকে হত্যা করে এবং তাকে ভীষণভাবে প্রহার করে আধা পঙ্গু করে দেয়। এ খবর পেয়ে সিপাহ্সালার নাসিরুদ্দীনের নেতৃত্বে গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সময় হযরত শাহ্ জালাল ইয়েমনি রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও নাসিরুদ্দীনের বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ৩৬০ জন সুফী নিয়ে এখানে আগমন করেন। গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে কারও মতে অসমের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। আবার কারও মতে সসৈন্যে নিহত হয়। সিলেটে ইসলামের বিজয় পতাকা যেদিন উড্ডীন হলো- সেদিন এখানে ইতিহাসের এক নবতর অধ্যায় সূচিত করল। সিলেট পরিণত হয়ে গেল ইসলামের রুহানী বিলায়েতের রাজধানী। অন্যদিকে যদি আমরা ব্রিটিশ আমলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর যেসব কারণে বাশের কেল্লা নির্মাণ করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গরু কোরবানি নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সেকালে হিন্দু জমিদারদের জমিদারি এলাকায় গরু কোরবানি দেয়া নিষিদ্ধ ছিল, কেউ যদি গোপনে গরু কোরবানি দিত তাহলে তা জানতে পারলে তাকে অর্থ জরিমানাসহ দৈহিক নির্যাতন ভোগ করতে হতো। যে কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে গরু কোরবানি প্রাধান্য পেয়েছে। কোরবানির পশুর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং পশুর চামড়া দান করে দেয়া আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুূক্ত হয়ে গেছে। কোরবানির ঈদের প্রায় এক মাস পরে আশুরা আসে। হযরত হুসায়ন রাদি আল্লাহু তায়ালা আন্্হু কারবালা প্রান্তরে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহররম সপরিবারে জান কোরবান করে ইসলামের ইতিহাসকে ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল করেন। কোরবানির ঈদও ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। যে কারণে অনেক পরিবারে কোরবানির গোশ্্ত আশুরা পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয় ইমাম হুসায়ন রাদি আল্লাহু তায়ালা আন্্হুর ইসালে সওয়াবের জন্য। কোরবানির ঈদের দিন ভোরবেলায় বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে গভীর এক অনন্য আনন্দ-আমেজ বিচ্ছুরিত হতে থাকে যার বহির্প্রকাশ ঘটে শিশু-কিশোর ও যুবকদের মধ্যে। প্রকৃতিকে যেন কে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে এমনতর পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। সকাল সকাল ভালভাবে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করে সাধ্যানুযায়ী পরিষ্কার ও পবিত্র ভাল পোশাক পরে, চোখে সুরমা লাগিয়ে, দেহে আতর মেখে, আতর ভেজানো তুলা কানের ভেতর গুঁজে, মাথায় টুপি দিয়ে সব পুরুষেরা, শিশুরা. বুড়োরা, কিশোররা পৌঢ়রা, যুবকরা সঙ্গী-সাথী নিয়ে ছোটে ঈদগাহে কিংবা মসজিদে। শহর এলাকাতে কোন কোন স্থানে মহিলারাও ঈদের জামাতে শরিক হন। ঈদগাহে বা মসজিদে যাওয়ার সময় উচ্চারিত হতে থাকে তকবীর : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল্্ হাম্্দ- আল্লাহ্্ মহান, আল্লাহ্্ মহান, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আল্লাহ্্ মহান, আল্লাহ্্ মহান, সব প্রশংসা তাঁরই জন্য। গ্রামগঞ্জে মসজিদের চারধার কিংবা ঈদগাহের চারধার রঙিন কাগজের তিন কোণা ছোট ছোট পতাকা রশিতে লাগিয়ে ঘিরে দেয়া হয়, প্রবেশ পথে স্থাপন করা হয় সুন্দর তোরণ যার মাথায় বড় করে লেখা থাকে ঈদ মোবারক। শহরেও ঈদ মোবারক লেখা পতাকা রাস্তার দুই পাশে কিংবা রাস্তার মধ্যস্থলে সারি সারি টাঙানো হয়। অনেক স্থানে রাস্তার মধ্যভাগের দ্বীপগুলো কাগজ কেটে কেটে নানা রঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। ঈদের নামাজের জামাত এক আনন্দমুখর অনুভবে অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব খুতবা দেন। অনেক স্থানের ঈদগাহতে বিশিষ্ট কোন আলিমকে দাওয়াত করে আনা হয়। ঈদের নামাজ শেষ হলে পারস্পরিক বুক মেলানো বা কোলাকুলির মধ্য দিয়ে এক অপরূপ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের স্ফুরণ ঘটে। এই বুক মেলানো বা কোলাকুলির মাঝে অনুরণিত হয় ঐক্য ও সংহতির আহ্বান। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের সামনে সেই বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন : তোমাদের একের ধন সম্পদ, মান-ইজ্জত, রক্ত-প্রাণ অপরের কাছে আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো পবিত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে। ১০ হিলহজ প্রতি বছর ঈদ-উল-আজহাতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অলক্ষ্যে যেন উচ্চকিত হয়ে ওঠে বিদায় হজের সেই বাণী, তা যদি সারা বছরটায় বজায় রাখা যেত তাহলে কতই না ভাল হতো। আল্লাহ্্ও নির্দেশ দিয়েছেন : তোমরা আল্লাহর রজ্জু সবাই মিলে মজবুত করে আঁকড়ে ধর এবং কোন অবস্থাতেই তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৩)। ঈদের নামাজ শেষ হয়ে গেলে সামর্থ্যবানগণ পশু কোরবানি দেন। ঈদের দিন সকালেই কোরবানির পশু গরু বা ছাগলকে ভালভাবে গোসল করানো হয় এবং খাবার ও পানি তার সামনে রেখে দেয়া হয় যার থেকে ওরা খেয়ে নেয়। নামাজ পড়ে এসে পশুকে শোয়ায়ে অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে তকবির দিতে দিতে কোরবানি দেয়া হয়। যদি গরু হয় তবে ৭ জনে মিলে কোরবানি দেন আর ছাগল হলে একজনেই কোরবানি দেন। পশু জবেহ্ করার সময় থেকে গোশ্ত তৈরি এবং ভাগ-বাটোয়ারা পর্যন্ত প্রত্যেক কোরবানিস্থলে মানুষের, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের আনন্দ ভিড়ে মুখর হয়ে থাকে। গোশ্্ত তৈরি হওয়ার পর তা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে তিনটি ভাগ করা হয়। এক ভাগ বিতরণ করা হয় পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে আর এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে; বাকি এক ভাগ পরিবারের সদস্যদের জন্য রাখা হয়। কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিরাজমান। এই কোরবানির প্রেরণা আমাদের ভাষা আন্দোলনকে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে যেন সবার অজান্তেই উদ্দীপনা যুগিয়েছে। বাংলা কাব্যের বিশাল আঙ্গিনাজুড়ে কোরবানির ঈদ স্থান করে নিয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উচ্চারণ মেখে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলা যায় : ওরে হত্যা নয় এ, সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন। ঈদ-উল-আজহা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রাণস্পন্দনকে প্রবল শক্তির জোয়ারে দৃঢ়প্রত্যয়ী করে তোলে এবং অনুপ্রাণিত করে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও ঐতিহ্যগত আদর্শ সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। ঈদ-উল-আজহা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, বিশ্ব মুসলিম সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মাহই এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আজ সারা দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় কবির ভাষায় বলি : ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ইবরাহীমের মতো আবার/কোরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×