ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চীনা নিরাপত্তা আইনে হংকংবাসীর জীবন শুরু

প্রকাশিত: ১২:০৪, ২ জুলাই ২০২০

চীনা নিরাপত্তা আইনে হংকংবাসীর জীবন শুরু

অনলাইন ডেস্ক ॥ হংকংয়ে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর করার মাধ্যমে—যে আইনটি ৩০ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে—চীন যদি ভেবে থাকে যে, তারা তাদের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে, তাহলে তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেননা ওই আইন এবং ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশদের হাত থেকে হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর বার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই অঞ্চলটির বাসিন্দারা চীনবিরোধী বিক্ষোভ করেছে আজ। সদ্যপ্রণীত ওই আইনের অধীনে প্রথমবারের মতো গ্রেফতারের ঘটনাগুলো ঘটেছে একইসঙ্গে। জুলাইয়ের প্রথমদিন সন্ধ্যায় গ্রেফতার হয়েছেন শত শত বিক্ষোভকারী। আইনটি প্রয়োগ করা হবে, এমন ব্যানার নিয়ে পুলিশকে টহল দিতে দেখা গেছে। সঙ্গে তাদের কাছে মজুত ছিল জল কামান, কাঁদানে গ্যাস এবং পিপার স্প্রে। হংকংয়ের জন্য চীন প্রণীত নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা আইনে বিচ্ছিন্নতাবাদ, কেন্দ্রীয় সরকার পতন, সন্ত্রাসবাদ ও ‘জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে আঁতাতমূলক যেকোনো কাজ’ শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। স্বাধীকার আন্দোলন দমনের লক্ষ্যেই আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির জন্য আইনটি তৈরি করেছে বেইজিং। উল্লিখত অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। দীর্ঘদিন ধরেই হংকংয়ে স্বাধীনতার দাবিতে তৈরি হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে বেইজিং কর্তৃপক্ষের তৈরি কথিত এই জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পরপরই এর আওতায় প্রথম গ্রেফতারের ঘটনাটি ঘটেছে হংকংয়ের স্বাধীনতার দাবিতে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানোর অভিযোগে। প্রত্যাশিতভাবেই আইনটি এবং এর শর্তাবলী কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এর কঠোরতা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। অবশ্য বেশিরভাগ বিশ্লেষকরা যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন আইনটি তার চেয়েও আরও কঠোর, এর বিধিগুলো আরও সুদূরপ্রসারী আর স্থানীয় আইনগুলোকে উপেক্ষা করে সহজেই যা কার্যকর করা যায়। সমালোচনা ও বিরোধিতা উপেক্ষা করেই চীনের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপল’স অব কংগ্রেসে কোনো কাটাছেঁড়া ছাড়াই সর্বসম্মতিক্রমে ৩০ জুন চূড়ান্তভাবে আইনটি পাস হয়। পাস হওয়ার পর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গতকালই আইনটিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর মধ্যরাতেই হংকং সরকারে গেজেট প্রকাশ করলে আইনটি কার্যকর হয় হংকংয়ে। চীন গত মে মাসেই হংকংয়ের নিজস্ব আইন পরিষদকে (লেগকো) কিছু না জানিয়েই এমন একটি আইন পাস করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল। এমনকি আইনটি হংকংয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসার আগেই অর্থাৎ তারা জানার আগেই আইনটি নিয়ে প্রশংসাপূর্ণ বিলবোর্ডগুলো হংকংজুড়ে বিভিন্ন স্থানে সেঁটে দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা তখন জানান যে, বিলটি (যা এখন আইনে পরিণত) আইনের শাসনের গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, যদি হংকংয়ের বিদ্যমান আইন এবং নতুন এই আইন সাংঘর্ষিক হয় কোনো কারণে তাহলে কথিত এই নিরাপত্তা আইনই অগ্রাধিকার পাবে। এই আইনের ফলে বেইজিংয়ের আইনসভা হংকংয়ের আদালতের যে কোনও রায় এবং দণ্ড বাতিল করতে সক্ষম হবে। তবে হয়তো এর প্রয়োজন পড়বে খুব সামান্যই; কেননা হংকংয়ে বেইজিং সমর্থিত সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে যে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে আদালতে ওঠা মামলাগুলো কোন বিচারকরা পরিচালনা করবেন। হংকংয়ের পুলিশ এ জাতীয় অপরাধ তদন্ত করবে। তবে, ‘স্বল্পসংখ্যক’ কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চীনের মূল ভূখন্ডের অর্থাৎ চীনের কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পাবে। হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী একটি নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন, যার একটি আসন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘উপদেষ্টার’ জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এছাড়া চীনের নিরাপত্তা বাহিনী হংকংয়ে এখন প্রকাশ্যে একটি কার্যালয় খুলতে পারবে; যা তারা আগে পারত না। এই কার্যালয় জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত তথ্যগুলো সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবে। এর অর্থ, এমন কাউকে তারা সন্দেহ করলে স্থানীয় পুলিশ নিরাপত্তা আইনের অধীনে তাদের গ্রেফতার করবে। তারা হংকং নয় চীনা আইন অনুযায়ী কাজ করবে। আইনটি কার্যকর হওয়ার আগেও অবশ্য এটা হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করছিল। গত ৩০ শে জুন হংকংয়ের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী জোশুয়া ওয়াং এবং ছোট গণতন্ত্রপন্থী দল ডেমোসিস্টো থেকে আগত নেতাকর্মী ও তরুণ সহকর্মীরা ঘোষণা দেন দলটি আগেই ভেঙে পড়েছিল। দল না থাকলেও জোশুয়া ওয়াং অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তার এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি আমার জন্মভূমি হংকংকে রক্ষার কাজ চালিয়ে যাবো এবং এই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব; যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা চুপ হবে কিংবা কিংবা আমাকে আমার জন্মভূমি থেকে অদৃশ্য করে দেবে।’ তার এমন জোরালো অবস্থানই তার কণ্ঠে হংকংয়ের চীনবিরোধী অন্যান্য বিক্ষোভকারীদেরও। ফলে তাদের নিয়ে ভীত হওয়ার বিষয়টি তাতে উঠে এসেছে। জোশুয়ার ওই ছোট স্বাধীনতাকামী সংগঠন ছাড়াও হংকংয়ের স্বাধীনতার জন্য প্রচারণা চালিয়েছে কিংবা বিক্ষোভ করেছে এমন আরও তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীও নিজেদের দলীয় কাঠামো ভেঙ্গে দিয়েছে। অনেক পশ্চিমা দেশ আইনটি নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে; যাদের অভিযোগ ১৯৯৭ সালের ‘এক দেশ, দুই নীতি’র চুক্তির আওতায় ৫০ বছরের রুপান্তরকালে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও চীন সেই প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করছে। অথচ এই সময়ে অঞ্চলটির বাসিন্দাদের রাজনৈতিক ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা সংরক্ষিত থাকার কথা ছিল। ১ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টে বলেছেন, আইনটি কার্যকর করা সেই চুক্তির ‘স্পষ্ট ও গুরুতর লঙ্ঘন’। চীন আইনটি প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হংকংয়ের নাগরিকদের ব্রিটেনে বসবাসের সুযোগ সংক্রান্ত ব্রিটিশ ন্যাশনাল অভারসিজ (বিএনও) পাসপোর্ট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন তিনি। এর মাধ্যমে তাদের বিট্রেনের পুর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ তৈরি হবে। এই পাসপোর্ট পাবেন হংকংয়ের ৩০ লাখ বাসিন্দা। যুক্তরাষ্ট্রও হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, তারা হংকংকে দেওয়া বিশেষ বাণিজ্য মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেবে এবং অঞ্চলটিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের অবিভেদ্য অংশ হিসেবেই বিবেচনা করবে। ইতোমধ্যে, ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকান সংস্থাগুলোকে মূল ভূখণ্ড চীনে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রফতানির লাইসেন্স নিতে ছাড় দিয়ে হংকংয়ের প্রাপ্ত অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা স্থগিত করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এই ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘বেইজিং এখন হংকংকে এক দেশ, এক নীতির আওতায় বিবেচনা করে, তাই আমরা এখন কেন এক দেশ দুই নীতি চালু রাখবো। আমরাও অবশ্যই তাদের মতো অবস্থানে যাবো। আর তাই হংকংকে এতদিন ধরে দেওয়া এই সুবিধা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োজিত হংকংয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা লাও সিউ-কাই বলছেন, বানরকে ভয় দেখানোর জন্য কয়েকটি মুরগি হত্যাই এই আইনের লক্ষ্য অর্থাৎ নির্বিচার গ্রেফতারের পরিবর্তে অল্পসংখ্যক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও জাতীয় নিরাপত্তা লঙঘনের দায়ে দণ্ড দিয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করা। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির মূল ভূখণ্ডেও ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে একইভাবে দমনাভিযান চালায়। তবে তথ্য-প্রমাণাদিতে দেখা যাচ্ছে, হংকংয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এই অঞ্চলটিকে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে নতুন আইনের কঠোর পরিণতির ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত রয়েছে। ইকোনোমিস্টে প্রকাশিত কলাম
×