ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডুবে যাওয়া মর্নিং বার্ড পুরোপুরি ভাসানো সম্ভব হয়নি

প্রকাশিত: ২২:২৯, ১ জুলাই ২০২০

ডুবে যাওয়া মর্নিং বার্ড পুরোপুরি ভাসানো সম্ভব হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার হলো। দুপুরে একজনকে উদ্ধার করেন ডুবুরিরা। আর বিকেলে একজনের লাশ নৌযান ডুবির স্থানে ভেসে ওঠে। নিহতদের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। বাকি চার জনের মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখনও একাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ থাকতে পারেন বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। এজন্য উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভাটি এলাকায় খোঁজ করা হচ্ছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি মঙ্গলবার দুপুরে টেনে মাঝ নদী থেকে কেরানীগঞ্জের দিকে তীরের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়। তবে লঞ্চটি পুরোপুরি ভাসানো সম্ভব হয়নি। যতদিন লঞ্চটি ডুবে থাকবে ততদিন সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী অভিযান চালানো হবে। এদিকে ধাক্কা দেয়া ময়ূর-২ লঞ্চের মালিকসহ সারেং ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পাশাপাশি মর্নিং বার্ড লঞ্চের মালিকসহ সারেংকেও খোঁজা হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকেল ছয়টা নাগাদ তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা দোতলা ‘মর্নিং বার্ড’ নামের একটি লঞ্চকে সোমবার সকাল দশটার দিকে ধাক্কা দেয় চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা ময়ূর-২ নামের একটি বিশালাকার তিন তলা লঞ্চ। এ সময় বড় লঞ্চটি ছোট লঞ্চটির মাঝ বরাবর প্রচ- গতিতে ধাক্কা দেয়। এতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডুবে যায় ছোট লঞ্চটি। সোমবার সারারাত উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। তবে কোন লাশ উদ্ধার হয়নি। সোমবার রাত সাড়ে দশটার দিকে প্রায় সাড়ে বারোঘণ্টা পর সুমন ব্যাপারী নামের মাঝবয়সী ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর ডুবুরিরা। এদিকে উদ্ধারকৃত লাশগুলো সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে রাখা হয়। সেখান থেকে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পাশাপাশি বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে উদ্ধার তৎপরতা। মঙ্গলবার সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর ডুবুরিরা টানা উদ্ধার অভিযান চালাতে থাকেন। ফায়ার সার্ভিসের ১৪ জনসহ ২০ ডুবুরি লঞ্চের ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালাতে থাকেন। তারা ছুরিসহ ভারি জিনিসপত্র নিয়ে তল্লাশি চালান। যাতে কোন কিছু ভেঙ্গে হলেও অভিযান চালানো সম্ভব হয়। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর ডুবুরিরা একজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আরও একজনের লাশ ঘটনাস্থলে ভেসে ওঠে বলে জনকণ্ঠকে জানান ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডিউটি অফিসার এরশাদ শিকদার। সদরঘাটে ফায়ার সার্ভিসের অস্থায়ী মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রায়হান জনকণ্ঠকে বলেন, যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তাকে ডুবুরিরা লঞ্চের জেনারেটরের রুম থেকে উদ্ধার করেন। ডুবুরিদের ভাষ্য মোতাবেক জেনারেটরের রুম ভেতর থেকে আটকানো ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর বের হতে না পেরে প্রাণ বাঁচতে ওই যুবক জেনারেটরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। জেনারেটরের রুমের দরজা ভেঙ্গে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। বিকেলে আরও একজনের লাশ ভেসে ওঠে। এই নিয়ে ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার হলো। আর জীবিত উদ্ধার হয়েছে দুজন। ডুবুরিদের বক্তব্য মোতাবেক ভেতরে প্রায় সব জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। আর কোন লাশ নেই। তবে লাশ ভেসে ভাটির দিকে যেতে পারে। কারণ এখনও অনেকেই তাদের আত্মীয়-স্বজন নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন। এজন্য ভাটির দিকে তারা লাশ খোঁজার কাজ অব্যাহত রাখবেন। এদিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি হাজার চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায়নি। অর্থাৎ পানির উপরে ভাসানো সম্ভব হয়নি। লঞ্চ ডুবির পর থেকেই উদ্ধার অভিযান চলায় বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছিল। বিশেষ করে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া এবং সদরঘাটে আসা সব নৌযানেরই চলাচলে অসুবিধা হচ্ছিল। এজন্য ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে এয়ার লিফটিংয়ের মাধ্যমে নদীর তলা থেকে খানিকটা উপরে তোলা হয়। তবে পানির উপরে না। পানির ভেতরেই মাটি থেকে সামান্য উপরে তুলে পরে সেটিকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ফরাজগঞ্জ ঘাট থেকে পশ্চিম দিকে কেরানীগঞ্জ তীরের দিকে খানিকটা নিয়ে যায়। আনুমানিক এক হাজার গজ পশ্চিম দিকে নেয়া হয়। বর্তমানে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের ৪ ডুবুরি স্ট্যান্ডবাই আছেন। তারা কাজ করছেন। আর নৌযানটি পানির উপরে ভাসানোর পর সেখানে ফায়ার সার্ভিসের চূড়ান্ত তল্লাশি চালানোর কথা আছে। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। এছাড়া লঞ্চটি ডুবে থাকা অবস্থায় সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী তল্লাশি অভিযান চালানো হবে। আর ভাটিতে লাশ ভেসে উঠে কিনা সে ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের নৌ ইউনিট তৎপর রয়েছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর রাখছেন। নৌ পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, লঞ্চ ডুবিতে হতাহতের ঘটনায় নৌ পুলিশের তরফ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে কেরানীগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন নৌপুলিশ সদরঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ শামসুল। মামলায় ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, সারেং ও তার সহযোগীসহ মোট সাত জনকে আসামি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ময়ূর-২ লঞ্চটি দুর্ঘটনার সময় মূল সারেং চালাচ্ছিলেন না বলে জানা গেছে। এক শিক্ষানবিস সারেং চালাচ্ছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ কাউকেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। চেষ্টা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি ডুবে যাওয়া মর্নিং বার্ড লঞ্চের মালিকসহ অন্যদের খোঁজা হচ্ছে। তাদের পাওয়া গেলে দুর্ঘটনা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। যদিও ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য দুই লঞ্চের সারেং ও তাদের সহযোগীদের গাফিলতি থাকার বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। নৌপথে চলাচল করতে নৌযানগুলোকে যেসব নিয়ম মেনে চলতে হয়, তার কোনটিই পালন করেনি দুর্ঘটনায় কবলিত দুটি লঞ্চের সারেং। মামলার আলামত হিসেবে লঞ্চ দুটি জব্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তাতে দুই লঞ্চেরই নিয়ম না মানার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। নিহতদের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় জানা গেছে। বাকি তিন জনের পরিচয় জানা যায়নি। বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক ও ঢাকা নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা এ কে এম আরিফ উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, লঞ্চ দুটির বিষয়ে সার্ভে করা হচ্ছে। ওই দুটি লঞ্চের রেজিস্ট্রেশন ঠিক ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়ম মেনে নৌযান দুইটি চলছিল কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া নৌ দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে গঠিত ৭ সদস্যবিশিষ্ট ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তরফ থেকে গঠিত চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি কাজ করছে। প্রসঙ্গত, নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। আর লাশ দাফনের জন্য প্রতি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। ময়ূরের মালিক, দুই মাস্টার ও সুকানির বিরুদ্ধে মামলা ॥ লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌ পুলিশের দায়েরকৃত মামলার আসামিরা হচ্ছে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ, মাস্টার আবুল বাশার, মাস্টার জাকির হোসেন, স্টাফ শিপন হাওলাদার, শাকিল হোসেন, হৃদয় ও সুকানি নাসির মৃধাসহ অজ্ঞাত পাঁচ-ছয় জন। এদিকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক কামরুন্নাহার মঙ্গলবার আগামী ১৭ আগস্টের মধ্যে মামলার প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
×