ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যত বেশি জাল টাকা তত বেশি দন্ড

প্রকাশিত: ২২:২৬, ১ জুলাই ২০২০

যত বেশি জাল টাকা তত বেশি দন্ড

রহিম শেখ ॥ যত বেশি নকল মুদ্রা তৈরি বা সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত হবে তার দণ্ড হবে তত বেশি। শাস্তি হিসেবে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে প্রথমবার কেউ জাল নোটের কারবারে জড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হবে না। এমনকি দ্বিতীয়বারেও নয়। টানা তিনবার ৫০০ পিসের বেশি জাল নোট নিয়ে ধরা পড়লে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়। জাল নোট ঠেকাতে সন্দেহজনক যে কোন স্থানে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে পুলিশকে। জাল নোট তৈরিতে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করতে পারবে পুলিশ। এছাড়া জাল নোটের ব্যাপারে তথ্য দিলে পুরস্কারের কথাও উল্লেখ আছে খসড়া আইনে। এই খসড়ার ওপর এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জনগণের মতামত নিচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থ-সামাজিক ক্ষতির গভীরতা বিবেচনায় নিয়ে শুরুর দিকে জাল নোটের কারবারিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সুপারিশ করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্দেস ব্যাংকের সহযোগিতায় ‘ফেক নোট এ্যানালাইসিস সেন্টার স্থাপন’ বিষয়ক একটি প্রকল্প নেয়। এর উদ্দেশ্য আসল নোটের নিরাপত্তা এবং জাল নোটের কারবার দমনের দক্ষতা বাড়ানো। জাল নোট কারবারিদের মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করায় জার্মানি সরকার ওই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়। পরে বুন্দেস ব্যাংক এক বিবৃতিতে জানায়, জাল করা গুরুতর অপরাধ, তবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও বাড়াবাড়ি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের খসড়াটি সংশোধনে কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে একবার খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সে বার মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সবশেষে জুন মাসে পুনরায় খসড়া চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাল নোটসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য আলাদা কোন আইন দেশে নেই। ফলে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯ (ক) থেকে (ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫ (ক) ধারা অনুযায়ী জাল মুদ্রাসংক্রান্ত অপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু এসব আইনে বিচার করতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা জাল নোট তৈরি করা হয় এমন কোন সন্দেহজনক স্থানে প্রবেশ, পরিদর্শন কিংবা বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালাতে পারবেন। তল্লাশির সময় সন্দেহভাজন কাউকে আটকও করা যাবে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এখন থেকে জাল নোট বিষয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মামলা করতে পারবে। এতদিন শুধু পুলিশ জাল মুদ্রার মামলা করতে পারত। আবার কারও কাছে জাল মুদ্রা থাকলেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। ওই জাল মুদ্রার বাহক আত্মপক্ষ সমর্থন বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পাবেন। বাহক যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি সরল বিশ্বাসে ওই মুদ্রা বহন এবং বৈধ লেনদেনের অংশ হিসেবে ধারণ করেছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হবে না। তবে জাল মুদ্রার বাহক যে উৎস থেকে এই মুদ্রা পেয়েছেন, তাকেও একই বিষয় প্রমাণ করতে হবে। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে জাল মুদ্রার সংখ্যা ১০ পিসের কম হতে হবে। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার ও পৌরসভার কাউন্সিলর, প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক বাহকের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। দশ পিসের বেশি জাল মুদ্রা কারও কাছে থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। খসড়া আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যত বেশি নকল মুদ্রা তৈরি বা সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণ হবে, তার দণ্ড তত বেশি হবে। আইনের খসড়া অনুযায়ী, যেকোন মূল্যের ১০০টির কম জাল মুদ্রা পাওয়া গেলে দুই বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। জাল মুদ্রার সংখ্যা ১০০টির বেশি কিংবা ৫০০টির কম হলে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। কোন ব্যক্তি এই আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে দণ্ড বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ১০০টির কম জাল মুদ্রার জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। জাল মুদ্রার সংখ্যা ১০০টির বেশি কিংবা ৫০০টির কম হলে সাত বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আর ৫০০টির বেশি হলে ১২ বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কোন ব্যক্তি এই আইনের ধারায় তৃতীয়বার বা তার চেয়ে বেশিবার অপরাধী প্রমাণিত হলে শাস্তি আরও বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ১০০টির কম জাল নোটের জন্য ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। জাল নোটের সংখ্যা ১০০টির বেশি কিংবা ৫০০টির মধ্যে থাকলে ১২ বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আর ৫০০টির বেশি জাল মুদ্রার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনুর্ধ এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। জাল নোটের ব্যাপারে তথ্য দিলে পুরস্কারের কথাও উল্লেখ আছে খসড়া আইনে। এতে বলা হয়েছে, জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ধারণ, বহন, সরবরাহ, আমদানি-রফতানি এবং মুদ্রা প্রস্তুতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সম্পর্কে তথ্য দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকার পুরস্কৃত করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এতদিন সিভিল পেনাল কোড অনুযায়ী জাল নোটের অপরাধীদের বিচার হতো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল যার কাছে জাল নোট পাওয়া যেত, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হতো। এজন্য প্রস্তাবিত আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
×