ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ বৃক্ষের অনিন্দ্য সুন্দর ফুল

প্রকাশিত: ২১:৩২, ১ জুলাই ২০২০

বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ বৃক্ষের অনিন্দ্য সুন্দর ফুল

মোরসালিন মিজান ॥ আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে...। জীবনানন্দ লিখেছিলেন। কবি আর নেই। চলে গেছেন। তবে তার প্রিয় চালতা ফুল ফুটছে সময়মতোই। কবি দেখতে পারছেন না। দেখতে যে পারবেন না, তিনি জানতেন। তাই কবিতায় সেই মনোকষ্টের কথা আগাম লিখে গিয়েছিলেন। একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে বিষ্ণু দে তাই লিখেছিলেন: আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে...। আরও অনেক কবিতা গল্পে চালতা ফুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। কারণ চালতা সত্যি দেখার মতো ফুল। খুব ভাল করে তাকালে চোখ আটকে যায়। একদম ফেরানো যায় না। মজার ব্যাপার হলো, চালতা গ্রামে ফলের জন্য পরিচিত। শহরে প্রিয় ফুলের জন্য। ফুল মূলত বর্ষায় ফুটে। এই আষাঢ়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে বলা পুরোপুরি ঠিক হবে না। যতদিন যাচ্ছে গাছটি তত দুর্লভ হয়ে উঠছে। একসময় দেশের প্রায় সব গ্রামেই ব্যাপক হারে ছিল। বাড়ির পেছনের ঝোপ জঙ্গল থেকে দু’একটি চালতা গাছ নিশ্চিত উঁকি দিত। অতিচেনা গ্রামীণ বৃক্ষ এখন অনেক কম দেখা যায়। সংখ্যাটা একেবারেই কমে এসেছে। যতদূর তথ্য, চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে. জে. ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজী নাম এলিফ্যান্ট এ্যাপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। চালতা ফুল আকারে বেশ বড় হয়। গাছের ঘন পাতার আড়ালে চোখ জোড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে থাকে। ফুলের সাদা পাঁচটি পাপড়ি। বেশ মোটা ও মাংসল। গোলাকার ফুলের পরাগকেশর অসংখ্য। দৃষ্টিনন্দন ফুল কয়েকটি পর্যায়ে নিজেকে বিকশিত করে। ক্রমে বাড়তে থাকে সৌন্দর্য। পাতার সৌন্দর্যও বলে শেষ করা যাবে না। আয়তাকৃতি পাতার খাঁজকাটা আউটলাইন। করাতের দাঁদের মতো দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয়, কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নক্সা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু। সমান্তরাল। গ্রামে অযতেœ থাকলেও, শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে চালতা গাছ লাগানো হয়। এমনকি রাজধানী ঢাকায় কিছু গাছ আছে। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেনে আছে। আছে শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের পেছনের অংশে। বেইলি রোড সংলগ্ন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ ভবনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে আছে একটি গাছ। একটু অনুসন্ধিৎসু হলে আরও দেখা যাবে। এবার কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফুটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্ভমু-Ñ সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ফুলের গাছ ফলের জন্যও পরিচিতি আছে। বৃতিই এক সময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরত হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতার ফল হয় টক মিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁশ নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরির হয় চালতা ফল থেকে। গাছটি থেকে শক্ত কাঠ হয়। নৌকা তৈরিতে ব্যবহার কর হয় এ কাঠ। সবাই একটু আন্তরিক গাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। আমরা কি সে চেষ্টা করব না?
×