ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

এটা জাতীয় দুর্যোগ ॥ সরকার কী করবে ভেবে দেখুন

প্রকাশিত: ২০:১৮, ১ জুলাই ২০২০

এটা জাতীয় দুর্যোগ ॥ সরকার কী করবে ভেবে দেখুন

প্রায় আশি বছর আগে বাংলাদেশের কবি প্রয়াত আহসান হাবীব একটি কবিতা লিখেছিলেন, শিরোনাম ‘আজকের কবিতা।’ কবিতার ক’টি লাইন এখানে তুলে দিলাম: ‘আমাদের দিন মৃত্যু-তুহীন দীর্ঘায়ু হবে শ্যানবিধান মৃৎপিপাসা ও শান্তিহরণ চিরদিন রবে বিদ্যমান।’ আশি বছর পরেও মনে হয় এই কবিতা আজকের কবিতা। কবিরা হয়তো সর্বজ্ঞানী। তাই তারা আশি বছর পরের আজকের পৃথিবীরও নিপুণ বর্ণনা রেখে যেতে পেরেছেন। ঢাকার টেলিভিশনের খবর এখন শুনতে ইচ্ছে করে না। টিভি খুললেই মৃত্যুর খবর। আগে ছিল আপরিচিত জনের মৃত্যুর খবর। এখন রোজই শুনি পরিচিত জনের মৃত্যুর সংবাদ। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক অপরিচিত জনের মাঝে তিনজন পরিচিত জনেরও খবর পেয়েছি। একজন হলেন সাপ্তাহিক ‘আজকের সূর্যোদয়ের’ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোজাম্মেল হক, দ্বিতীয়জন মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের স্ত্রী এবং তৃতীয়জন হলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুল্লাহ আল মহসিন চৌধুরী। ‘আজকের সূর্যোদয়ের’ সম্পাদক মোজাম্মেল হকের মৃত্যু বড়ই মর্মান্তিক। করোনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিনি লকডাউনেই ছিলেন। তার বড় ছেলে লকডাউন শিথিল হওয়ায় অফিসের কাজে জয়েন করেছিলেন। অফিস থেকে জ্বর নিয়ে তিনি ঘরে ফিরেছিলেন। এটা ছিল করোনার জ্বর। এই ভাইরাস পিতা মোজাম্মেল হকের দেহেও সংক্রমিত হয়। পুত্র রোগমুক্ত হয়েছেন। কিন্তু পিতা রোগ থেকে বেঁচে উঠতে পারেননি। এই মৃত্যু তার পরিবার পরিজনকে কতটা শোকার্ত করবে তা ভাবতে পারা যায় না। মোজাম্মেল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় আরব-আমিরাতের শহর দুবাইতে। সে বহুবছর আগের কথা, সন তারিখ মনে নেই। দুবাইতে আওয়ামী লীগের সমর্থক বাঙালিদের এক সাংস্কৃতিক সম্মেলন হবে, সেখানে আমার আমন্ত্রণ। দুবাইয়ের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি আমাকে রিসিভ করার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে এক মাঝারি বয়সের ভদ্রলোকও রয়েছেন। পরিচয় দিলেন, তার নাম মোজাম্মেল হক। ঢাকা থেকে এসেছেন। সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের সম্পাদক। দুবাইতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পরদিন আরব আমিরাতে বসবাসকারী ‘আজকের সূর্যোদয়’ কাগজের পাঠকদেরও একটি সম্মেলন হবে। আমাকে সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। আমি লন্ডনে বসেই ‘আজকের সূর্যোদয়’ পত্রিকাটি হাতে পেয়েছি। পত্রিকাটিতে ‘গেদু চাচার চিঠি’ নামে একটি কলাম ছিল। অত্যন্ত জনপ্রিয় কলাম ছিল এটি। বাংলাদেশে ‘আজকের সূর্যোদয়’ খুব উন্নতমানের পত্রিকা বলে গণ্য হয়নি। কিন্তু গেদু চাচার চিঠি কলামটির জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পত্রিকাটির কাটতি ছিল অবিশ্বাস্য। আমি নিজেও কাগজটি হাতে পেলে কলামটি প্রথম পাঠ করতাম। একেবারে সাধারণ ভাষায়, অনেক সময় গ্রাম্য মুখের ভাষার মিশ্রণে পাঠককে মুগ্ধ করে রাখতেন লেখক তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। রাজনৈতিক বিশ্বাসে মোজাম্মেল হক ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী। সেই এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে নানা রাজনৈতিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে এবং সরল ভাষায় তা বিশ্লেষণ করে তার উপস্থাপনা ছিল অনবদ্য। এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সেই দাপটের আমলে গেদু চাচার চিঠিতে তাদের যে ভাষায় সমালোচনা করা হতো তা ছিল তার সাহসী সাংবাদিকতার পরিচয়। এই গেদু চাচার চিঠি ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাপ্তাহিকগুলোতে পুনর্মুদ্রিত হতে দেখেছি। বয়সও তার তেমন হয়নি। আমি ঢাকায় গেলে দেখা করতে আসতেন। এমন একটি মানুষ অসময়ে চলে গেলেন, তাও আবার করোনার হামলায় দারুণ কষ্ট পেয়ে, এটা শুনে মনে দারুণ ব্যথা পেয়েছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনকে আন্তরিক সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। স্বাভাবিক সময়ে এক মোজম্মেল হকের জন্য হয়তো অনেকেই শোক প্রকাশ করতেন, কিন্তু একজনের জন্য এই শোক প্রকাশের এখন সময় নেই। একজনের মৃত্যু সংবাদ আসতে না আসতেই আরেক জনের মৃত্যুর খবর পাই। এখন যাদের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি, তাদের অধিকাংশই বিশিষ্টজন, ঘনিষ্ঠ পরিচিতজন। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর পেতে না পেতেই পেয়েছি আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর খবর। তারপর কামাল লোহানী, মোজাম্মেল হক এবং আরও অনেকের মৃত্যুর খবর একের পর এক এসেছে। করোনা আতঙ্ক মানুষকে কতটা দিশেহারা করেছে তার ছোট একটা উদাহরণ দেই। ইতালির মিলান শহরে এক বাংলাদেশী যুবক বেশ কয়েক বছর ধরে আছেন। আমার পরিচিত পরিবার। স্বামী ব্যবসায়ের স্বার্থে মিলানে। তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে লন্ডনে থাকেন। তিনি প্রতিমাসেই দু’চারদিনের জন্য লন্ডনে স্ত্রী-পুত্র, কন্যাদের কাছে আসেন। এবার করোনার জন্য ইতালিতে আটকে পড়ে দু’মাস লন্ডনে আসতে পারেননি। সম্প্রতি দু’দেশেই করোনার কিছু উন্নতি হতেই তিনি লন্ডনে পরিবার পরিজনের কাছে ছুটে এসেছেন। তার স্ত্রী তাকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে দিন সাতেক আলাদা বিছানায় শুতে বলেছেন। বলেছেন, করোনার এই দুঃসময়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে এটুকু করা উচিত। এতে স্বামী উত্তেজিত হয়েছেন। স্ত্রীকে গালাগালি করেছেন এবং স্ত্রীর চরিত্রে অপবাদ দিয়ে তাকে ডিভোর্স দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। আমাকেই স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এই ঝগড়া মেটাতে হয়েছে। তাই বলছি, করোনা বা কোভিড শুধু নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে না; মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ভাঙ্গন ধরিয়েছে। লন্ডনের কাগজে খবর বেরিয়েছে, লকডাউনে থাকার সময় ব্রিটেনে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বেড়েছে। ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও খবর একই। করোনা পরবর্তী মানব সমাজ কী চেহারা ধারণ করবে তা আমরা এখন অনুমানও করতে পারছি না। কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘ সময়ের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মানব সমাজে হিংস্রতা বাড়তে পারে। সম্প্রতি লন্ডনে লকডাউন শিখিল করার পরই রাজপথে নাইফ ক্রাইম আবার শুরু হয়। একদিনে তিনজন ছুরি হামলায় মারা যায়। বোর্নমাউথ বীচে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়। তাতে পুলিশই আহত হয়েছে ২২ জন। গ্লাসগোয় পার্কে দাঙ্গা হয়েছে। অর্থাৎ, করোনা থেকে মানব সমাজের কোন শিক্ষা হয়নি। করোনার অভিশাপ মুক্ত হওয়ার পরও যদি মানব সমাজে তার অমানবিক দিকগুলো সংশোধিত না হয়, তা আমাদের মনে ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন আশা জাগাতে পারবে না। ভবিষ্যতের কথা থাক, বর্তমানের কথায় আসি। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। এজন্য আমলাচক্রের দায়িত্বহীনতা ও নব্য ব্যবসায়ীদের লোভান্ধতা আংশিক কারণ বলা যেতে পারে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর অবস্থা ইউরোপেও আবার দেখা দিতে যাচ্ছে। একে বলা হচ্ছে সেকেন্ড ওয়েভ অব করোনা বা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এই ঢেউয়ে কত লক্ষ মারা যাবে তা কেউ বলতে পারে না। ২৯ জুন সোমবারে লন্ডনের ডেইলি মেট্রো কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে খবরের ব্যানার হেডিং হলো- উই আর অন এ নাইফ এজ (আমরা বিপদের ছুরির আগায় আছি)। দ্বিতীয় হেডিং হলো, ব্রিটেন ফেসিং সিভিয়ার সেকেন্ড ওয়েভ অব কোভিড-১৯, ওয়ার্নস সাইনটিফিক এ্যাডভাইজার (ব্রিটেন দ্বিতীয় পর্যায়ের কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ হামলার মুখে, সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন সরকারের বিজ্ঞানী উপদেষ্টা)। যে ব্রিটেন করোনামুক্ত হতে চলেছে বলে মনে করা হয়েছিল, সেই ব্রিটেনের লেস্টার শহরে আবার রোগাক্রান্ত মানুষ পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি (মন্ত্রী) প্রীতি প্যাটেল দেশের মানুষকে এই ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। লেস্টার শহরে করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্য কর্র্তৃপক্ষ কঠোরভাবে লকডাউন ঘোষণা করবেন জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছেন, যেভাবে আবার করোনা বাড়ছে তাতে সারা দেশেই আবার লকডাউন জারি করা হতে পারে। অস্ট্রিয়া সরকার ঘোষণা করেছেন, তাদের দেশ করোনামুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ভাইরাসটির দ্বিতীয় পর্যায়ের আবির্ভাবে তারা আবার সর্বত্র লকডাউন আরোপের কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। সরকারের তরফ হতে একটি ইশতেহার প্রকাশ করে অস্ট্রিয়ানদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘সম্ভাব্য লকডাউন ঘোষণার কথায় আপনারা শঙ্কিত হবেন না। লকডাউন ঘোষণা করা হলে প্রত্যেক নাগরিকের বেসিক নীড্্স অর্থাৎ মূল চাহিদাগুলো সরকার পূর্ণ করবে। অর্থাৎ খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিনামূল্যে সকলের ঘর পৌঁছে দেয়া হবে।’ এটা ছাড়াও অস্ট্রিয়ার সরকার তাদের দেশের হোটেল-ইন্ডাস্ট্রি যাতে করোনাকালীন লকডাউনের জন্য ধ্বংস হয়ে না যায়, সে জন্য প্রত্যেক নাগরিকের কাছে ৫০ ইউরোর চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেন তারা এই চেক দেখিয়ে হোটেলে যায়। এইভাবে ইউরোপের করোনার দ্বিতীয় হামলা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও এই ভাইরাস কতটা প্রতিরোধ করা যাবে, সে সম্পর্কে প্রত্যেকটি দেশেরই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সন্দিহান। তারা সকলেই প্রতীক্ষা করছেন কত তাড়াতাড়ি একটি ভ্যাকসিন বা ইনজেকশন অবিষ্কৃত হয়। বাংলাদেশ এখনো করোনার প্রথম পর্যায়ের ধাক্কাই সামলে উঠতে পারেনি। ভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে বৈ কমছে না। এ জন্য একা সরকারকে দায়ী করে লাভ নেই। যে দেশের শিক্ষিত শহুরে মানুষের একটা অংশ ঈদের ছুটিতে গাড়ি হাঁকিয়ে দলে দলে গ্রামে ছুটে গিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে আসতে পারেন, শপিংমলে গিয়ে ভিড় জমাতে পারেন, সরকারের কোন বিধি নিষেধই মানছেন না, সেদেশের কী উপায় হতে পারে? আমার ভয় হচ্ছে আসন্ন ঈদ-উল-আজহা নিয়ে। যদি এবারেও বড় বড় গরুর হাট বসে, ক্রেতারা গরু কেনার জন্য ভিড় জমান এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্স না মেনে নামাজের জামাত হয়, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? এ জন্য সরকারের উচিত আগে থাকতেই প্রকৃত ধার্মিক আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অস্ট্রিয়ার মতো দেশের সকল নাগরিককে লকডাউনে রেখে ‘ফ্রি মিল’ দেয়ার সাধ্য বাংলাদেশ সরকারের থাকার কথা নয়। এবার ভাইরাস যখন শহর, বন্দর, গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়েছে তখন আবার লকডাউন কতটা কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল। তবে এই সময়টাকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার সকল স্তরের নাগরিকদের নিয়ে এই ভাইরাস দমনে কতটা কার্যকর কঠোর ব্যবস্থা নেবেন, তা ভেবে দেখতে পারেন। লন্ডন, ৩০ জুন, মঙ্গলবার, ২০২০
×