ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গোল্ডেন হ্যান্ডশেক

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১ জুলাই ২০২০

গোল্ডেন হ্যান্ডশেক

যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল অবশেষে তাই ঘটতে চলেছে। ক্রমাগত লোকসানের মুখে রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রবিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন। এর আওতায় প্রায় ২৫ হাজার পাটকল শ্রমিককে দেয়া হচ্ছে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক। মজুরি কমিশনের নিয়ম মেনে তাদের যাবতীয় পাওনা মিটিয়ে দেয়া হবে। এর জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। পাটকল শ্রমিক নেতাদের সিদ্ধান্ত মেনেই সরকার এটা করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটি মিল বন্ধ করে দেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সেই থেকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অনিবার্য পতন শুরু হয়। গত ৪০ বছর ধরে দফায় দফায় ভর্তুকি দানসহ প্রশাসনে পরিবর্তন করেও সফল হতে পারেনি পাটশিল্প। তবে সরকার একে ব্যর্থতা বলতে নারাজ। বরং নতুন করে পিপিপির আওতায় তথা সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন করতে চাইছে সরকার, যাতে সেগুলো লাভজনক হয়ে ওঠে। তবে পাটকলগুলো কেন লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি তার কারণ অনুসন্ধানও জরুরী ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে পাটের সুদিন আবার ফিরে এসেছে। এমনকি দেশেও বেসরকারী পাটকলগুলো ভাল করছে। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রফতানি আয়ও বাড়ছে। অথচ সরকারী পাটকলগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাটকলগুলোর লোকসান হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৯৫ কোটি টাকা। পাটকল শ্রমিক নেতাদের মতে সরকারী পাটকলের লোকসানের অন্যতম কারণ কাঁচাপাট কেনায় চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। মিল কর্তৃপক্ষ পাট কেনে দেরিতে এবং বেশি দামে। এছাড়াও সরকারী পাটকলের উৎপাদন ক্ষমতা কম, উৎপাদনে খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরনো ও মজুরি বেশি। তদুপরি চট ও চটের বস্তা ছাড়া আর কিছু তৈরি করতে পারে না সরকারী পাটকলগুলো। পাটকলের লোকসান কমাতে অভ্যন্তরীণ খাদ্য ও আনুষঙ্গিক দ্রব্য পরিবহনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বস্তাও সরকারী পাটকলগুলো সরবরাহ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তারা বেসরকারী পাটকলগুলোকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেয় বলে অভিযোগও রয়েছে। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য। সবচেয়ে বড় কথা, পাট থেকে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পচনশীল পলিথিন। বর্তমানে যে প্লাস্টিক পলিথিন দেশে ও বিদেশে যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে তা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য সমূহ ক্ষতিকর। সে অবস্থায় বিকল্প হিসেবে পাটের পলিথিন ব্যবহারের অত্যুজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ববাজারে পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে ৫০০ বিলিয়ন পিসের। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। পাট খাতের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে যে, চলতি বছরের মধ্যে সদস্যভুক্ত দেশসমূহ পণ্যের মোড়কসহ বহনের জন্য সব ব্যাগে প্লাস্টিক ও কৃত্রিম আঁশজাত উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করবে। বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের জন্মরহস্যের (জেনোম) তথ্য দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন নতুন জাতের পাটবীজ, যা থেকে প্রায় তুলার সুতার মতো স্বচ্ছ আঁশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে অচিরেই। এই সুতা দিয়ে উন্নতমানের জামদানিসদৃশ কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব। পাটের এই অমিত সম্ভাবনাকে বহুমুখী ও সর্বতোভাবে কাজে লাগাতে হবে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী দলসহ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের। আর তা হলেই কেবল ফিরে আসতে পারে প্রায় হারিয়ে যাওয়া পাটের স্বর্ণালি গৌরব। পিপিপির আওতায় পাটকটগুলোর কার্যক্রম শুরু হলে বিষয়গুলো যেন বিবেচনায় রাখা হয়।
×