ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কালো টাকা বিনিয়োগের শর্ত শিথিল করে অর্থবিল পাস

প্রকাশিত: ২২:৩২, ৩০ জুন ২০২০

কালো টাকা বিনিয়োগের শর্ত শিথিল করে অর্থবিল পাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের শর্তও শিথিল করা হলো। নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিন বছর তা বাজারে রাখার যে শর্ত দেয়া হয়েছিল, তা কমিয়ে এক বছর করা হয়েছে। এর সঙ্গে ছোটখাটো কিছু সংশোধনীর মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদে সোমবার অর্থবিল ২০২০ পাস হয়েছে। বিল পাসের আগে দেয়া বাজেটের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এবারের বাজেট বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে দেশের সকল মানুষ; যারা আমাদের প্রাণশক্তি। আর সকলের সহযোগিতা নিয়ে আমরা প্রমাণ করব, এত বড় বাজেটও বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সোমবার সকালে স্পীকার ড. শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হলে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিরোধী দলীয় উপনেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের আলোচনার পর বাজেটের ওপর আলোচনার সমাপনী টানেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে আগামী অর্থবছরে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকার একটি থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট প্রণয়নের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের শেকড়ের সন্ধানে গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমাদের শেকড় হলো আমাদের কৃষি। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি। এ জন্য কৃষি খাতকেও বাজেটে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে এখনও আমাদের শতকরা ৪০ ভাগের মতো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই কৃষি খাতই হতে পারে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার এক মৌলিক এলাকা।’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আমরা এ অঞ্চলের অনেকের খাদ্য জোগান দিতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আমাদের কঠোর পরিশ্রমের আত্মপ্রত্যয়ী কৃষক ভাইদের কারণে অতি সম্প্রতি আমরা ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে চাল উৎপাদনে আমাদের অবস্থান করে নিয়েছি। গত ৫০ বছরে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ। যা বিশ্বে একটি রেকর্ড।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিডের কারণে যারা কাজ হারিয়েছে-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, জেলে, স্বাস্থ্যকর্মী, ভ্যানচালক, রিক্সাচালকসহ সকল পেশার মানুষ। পান দোকান, মুদি দোকান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র কুটির এবং ছোটবড় সকল ব্যবসায়ী, সকল শ্রেণীর, নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যারা কষ্টে আছেন তাদের সকলের জন্যই এবারের বাজেট। এদেশের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এ বাজেট থেকে বাদ দিতে পারিনি। কাউকে বাদ দিতে পারলে বাজেটের আকার অবশ্যই ছোট রাখা যেত, ছোট রাখা যেত আমাদের বাজেট ঘাটতিও।’ মন্ত্রী বলেন, ‘সত্য যে বড় কঠিন। তাই সব জেনেশুনে আমরা কঠিনকে ভালবেসেছি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এবারের বাজেটটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কারণ এটি আকারে অনেক বড়। কিন্তু আমরা এই বাজেটটি বাস্তবায়নের বিষয়ে আশাবাদী।’ এ প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিগত পাঁচ বছরের প্রত্যেকটি বাজেটে আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম তার চাইতে প্রকৃত অর্জন আরও অনেক বেশি ছিল। বিগত ১০ বছরে জিডিপিতে আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮৮ শতাংশ। যা বিশ্বের সবার ওপরে। আমাদের কাছাকাছি ছিল চায়না (চীন) ১৭৭ শতাংশ নিয়ে। আর ভারত ছিল ১১৭ শতাংশে। গত ১১ বছরে আমাদের জিডিপির আকার বেড়েছে তিনগুণ।’ তিনি বলেন, ‘বাজেট উপস্থাপনের সাতদিন পরেই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আরেকটি গবেষণা করে। সেখানে তারা দেখিয়েছেন, এ বছর বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের প্রক্ষেপণ হলো ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আমাদের কাছাকাছি তাদের প্রক্ষেপণ। সুতরাং, আমরা বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ, আমরা সক্ষম হবো আমাদের এই বাজেটটি বাস্তবায়ন করতে।’ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের এই দেশটি একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এখনও আমরা আমাদের অর্থনৈতিক এলাকার যে চালিকাশক্তিগুলো আমরা এখনও সম্পূর্ণভাবে কোনটাই এক্সপান্ড করতে পারি নাই। আমরা কৃষির কথা বলেছি, শিল্পের কথা বলেছি, আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতিক লভ্যাংশ) বলেছি। কিন্তু কোনটাই আমরা পূর্ণমাত্রায় অর্জন করতে পারি নাই’। মন্ত্রী বলেন, ‘বারবার একটিমাত্র কথা উঠে আসে যে, আমাদের রেভিনিউ টু জিডিপির অনুপাত একদম কম, অনেক কম ১০ ভাগেরও নিচে। আমাদের মতো দেশ কারোরই ১৮ পার্সেন্টের নিচে না। আমরা হিসাব করে দেখেছি, এই ১০ ভাগ থেকে যদি ১৪ ভাগে উঠতে পারি, মাত্র চার ভাগ, তাহলে আমাদের বছরে আমরা অর্জন করতে পারি আরও এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আরও বেশি করতে পারলে তো আরও বেশি সম্ভাবনা আছে। এজন্য কী কাজ দরকার? একটিমাত্র কাজ- সেটি হচ্ছে আমাদের অটোমেশন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গতবছর অটোমেশন শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারি নাই। করোনার জন্য শেষ হয় নাই। আমরা বিশ্বাস করি, যত দ্রুত সম্ভব এই বছর এটা আমরা বাস্তবায়ন করবই ইনশাআল্লাহ। এটা করে আমরা প্রমাণ করব, এত বড় বাজেটও বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’ বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় অর্থবিল ২০২০ পাসের আইন প্রণয়ণ কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের শুরুতেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সদস্যদের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায। পরে বিলের ওপর সরকার ও জাতীয় পার্টির সদস্যরা বেশ কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। এরমধ্যে কিছু প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করেন, বাকিগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক গৃহীত সংশোধনীগুলোর অন্যতম হলো সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিনাজপুরের-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সংশোধনীটি। এই সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি প্রস্তাব করেন, পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের ‘লক ইন’ ৩ বছরের পরিবর্তে ১ বছর করা। যা অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গে অন্য কিছু সংশোধনী এনে অর্থবিল পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। ফলে আগামী বুধবার থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরে যারা পুঁজি বাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করবেন, ওই টাকা এক বছর পরই তারা আবার বাজার থেকে তুলে নিতে পারবেন। উল্লেখ্য, গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে তার বাজেট প্রস্তাবে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ আরও বিস্তৃত করেন। কোন প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও এ্যাপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ গত অর্থবছরেই ছিল। ২০২০-২১ সালের বাজেটে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোন সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রেও একই সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কোন জরিমানা ছাড়া কেবল ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ তার অবৈধভাবে অর্জিত অথবা কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে সঞ্চিত অর্থ এসব খাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা সরকারের অন্য কোন কর্তৃপক্ষ ওই টাকার উৎস জানতে চাইবে না। তবে কেউ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন শেয়ারে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে তিন বছরের ‘লক ইন’ বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার শর্ত দেয়া হয়, যা পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পাশাপাশি বালাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও ‘লক ইনের’ ওই শর্ত তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছিল। এভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সেদিন বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে’ আয়কর অধ্যাদেশে এই ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করছেন তিনি। তবে এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলে সৎ করদাতাদের প্রতি ‘অবিচার’ করা হয় বলে অনেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। সোমবার অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজারে কালো টাকার ‘লক ইন’ ৩ বছরের পরিবর্তে ১ বছর করে তার সঙ্গে অন্য কিছু সংশোধনী এনে অর্থবিল পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। আজ মঙ্গলবার পাস হবে মূল বাজেট। কাল ১ জুলাই বুধবার থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
×