ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিল ‘মর্নিং বার্ড’

সদরঘাট ও মিটফোর্ডে স্বজনহারাদের আহাজারি

প্রকাশিত: ২২:২৭, ৩০ জুন ২০২০

সদরঘাট ও মিটফোর্ডে স্বজনহারাদের আহাজারি

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ব্যবসায়ী মাসুদ তার দুই মামা -আফজাল শেখ ও বাচ্চু শেখকে খুঁজছেন। লঞ্চডুবিতে তার দুই মামা এখনও নিখোঁজ। একই লঞ্চের কেবিনে করে তারা সদরঘাট আসছিলেন। সদরঘাটের জেটিতে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তখন সকাল সাড়ে ৯টা। তাদের লঞ্চ ঘাটে ভেড়ার জন্য সোজা আসছিল। অন্য একটা বড় লঞ্চ ঢাকা-চাঁদপুর রুটের ময়ূর-২ বাঁকাপথে রওনা দিতে থাকে। বাঁকা পথে রওনা দেয়াতে ওই লঞ্চটি ধাক্কা দিয়েছে আমাদের লঞ্চের মাঝে। ধাক্কা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটা কাত হয়ে ডুবে যায়। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে তাদের লঞ্চটি তলিয়ে যায়। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার বর্ণনা করতে গিয়ে ডুবেযাওয়া লঞ্চযাত্রী মাসুদ জানান, আমি কেবিনে ছিলাম। গ্লাস খুলে আমি বের হইছি। ভেতরে আমার আপন দুই মামা- আফজাল শেখ ও বাচ্চু শেখ ছিলেন। তারা তো বের হতে পারেননি। তাদের খোঁজ করছি। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা সদরঘাট জেটিতে দাঁড়িয়ে মাসুদ জানান, রাজধানীর ইসলামপুরের গুলশানআরা সিটিতে কাপড়ের ব্যবসা করেন তিনি। প্রতিদিন তিনি সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে কাপড়ের দোকান করেন। রবিবার ময়মনসিংহ থেকে তার দুই মামা তাদের মুন্সীগঞ্জের বাসায় বেড়াতে যান। তাদের নিয়ে আজ (সোমবার) সকালে ঐ লঞ্চের একটি কেবিনে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু লঞ্চ পাড়ে ভেড়ার আগে মুহূর্তেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তিনি জানান, এখন আমি বাড়িতে কি বলব। দুই মামা মারা গেছে। তাদের খুঁজেও পাচ্ছি না। এই বলে ব্যবসায়ী মাসুদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর লঞ্চে থাকা প্রায় ৫০ জনের মতো যাত্রী আমরা সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারছি। বাকি যাত্রী কেউ উঠতে পারেনি। তারা লঞ্চের ভেতরেই ছিলেন। আমরা প্রায় ১৫০ জনের মতো লোক ছিলাম। এ রকমই মৃত্যুর কাছ থেকে বেঁচে যাওয়া মুন্সীগঞ্জের আবদুর রউফ। লঞ্চডুবিতে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু সত্য রঞ্জন বণিক মারা গেছে। তারা এক সঙ্গে ওই লঞ্চে ঢাকা আসছিলেন। তিনি জানান, ২০ বছর ধরে রোজ লঞ্চের যাত্রী হয়ে সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার ঢাকা থেকে বিকেলে মুন্সীগঞ্জে চলে যান। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল সাড়ে ৭টায় মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটিতে আমি ও বন্ধু সত্য রঞ্জন বণিক ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। সকাল পৌনে ৯টার দিকে লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের দু’শ’ গজ দূরে ছিল। ঘাট কাছাকাছি আসায় যাত্রীরা লঞ্চ থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখন সদরঘাটের একটি বড় লঞ্চ পেছন থেকে তাদের লঞ্চকে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তে লঞ্চ পানিতে তলিয়ে যায়। আব্দুর রউফ জানান, ওই লঞ্চডুবিতে বন্ধু সত্য রঞ্জন মারা গেছেন। ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে গেছি। আব্দুর রউফের তখনও ভয় কাটছিল না। তিনি কি সত্যি বেঁচে আছেন! এ সময় তিনি জানান, লঞ্চটি সদরঘাটের একেবার কাছে চলে আসে। আমরা নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ঘাটের খালি একটি লঞ্চ তাদের লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। ভয়ে আমরাসহ লঞ্চের সকল যাত্রী বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার চেঁচামেচি করছিলাম। সবাই আল্লাহকে ডাকছিলেন। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের লঞ্চটি উল্টে যায়। আমরা ছিলাম লঞ্চের নিচের তলায়। এ সময় দুই বন্ধু পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকি। দম আমার বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি পানির উপরে উঠতে পারি। বেঁচে যাই। কিন্তু আমার বন্ধু সত্য রঞ্জন উঠতে পারেনি। সে মারা গেছে। আবেগ আপ্লুত আবদুর রউফ জানান, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে প্রতিদিন মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে সদরঘাটে আসি। লঞ্চের যারা মারা গেছেন বা ডুবে গেছেন, তাদের অনেককে তিনি ভাল করে চেনেন। কারণ এসব মানুষ মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার মুন্সীগঞ্জে চলে যান। তিনি জানান, আমাদের লঞ্চটিতে ৫০ থেকে ৬০ যাত্রী ছিল। নিয়ম মেনে ঘাটে ভিড়ছিলেন। হঠাৎ করে অন্য লঞ্চটি ধাক্কা দিয়ে এই মানুষগুলোকে মেরে ফেলল। আমিও মরে যেতে পারতাম। এদিকে বাবার সত্য রঞ্জনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মিটফোর্ড মর্গে ছুটে আসে তার বড় মেয়ে দোলা বণিক। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, বাবা সত্য রঞ্জনের মিটফোর্ডে দোকান আছে। আমি থাকি ঢাকায়। আমার বাবা প্রতিদিন মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। আবার কাজ শেষে চলে যান। গত পরশু দিন আমার বাবা আমার বাসায় আসেন। আমি বাবাকে বলি, বাবা, এখন করোনাভাইরাস। তুমি লঞ্চে করে যাতায়াত করো না। আমার বাসায় থেকে ব্যবসা করো। কিন্তু আমার বাবা কথা শুনল না। চলে গেল। এখন আমি কাকে বাবা বলে ডাকব। মিটফোর্ডে স্বজনদের আহজারি ॥ এদিকে সকালে লঞ্চডুবির সংবাদ পেয়ে অনেকে প্রিয়জনের লাশের খোঁজে সদরঘাট ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ছুটে আসেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ প্রিয়জনের লাশ শনাক্ত করতে পেরেছেন। তবে বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত স্বজনদের লাশ খুঁজে পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরে কেউ প্রিয়জনের লাশ পেয়ে কাঁদছেন। আবার কেউ এখন পর্যন্ত স্বজনের মুখটি দেখতে না পেয়ে কাঁদছেন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সদরঘাটে লঞ্চডুবির ঘটনায় বাড়ে লাশের মিছিল। একের পর এক মরদেহ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। মর্গে সারি সারি লাশের মাঝে আপনজনের লাশ খুঁজে ফিরছে স্বজনরা। বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ও মিটফোর্ড হাসপাতালের স্বজনহারাদের কান্নায় সেখানে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। স্বজনহারাদের কান্নায় ঘটনাস্থলে দেখতে আসা অনেক দর্শনার্থী নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। দুপুরে আপনজনের লাশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল অনেক স্বজন। এমনই একজন মুন্সীগঞ্জের পরশ আলী (৩০)। দুর্ঘটনায় তার ভাই নিখোঁজ ছিলেন। পরে উদ্ধারকৃত মরদেহগুলো থেকে তার ভাই সুমন তালুকদারকে (৩৫) শনাক্ত করেন তিনি। পরশ আলী জানান, তার ভাই সুমন তালুকদার যমুনা ব্যাংক ইসলামপুর শাখায় সাব-কনট্যাক্টের ভিত্তিতে কাজ করতেন। লঞ্চডুবির ঘটনায় তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরে ভাই সুমনের মরদেহ শনাক্ত করা হয়। নিখোঁজদের স্বজনরা বুড়িগঙ্গার তীরে এসে ভিড় করেছেন। রাজ্জাক নামে একজন জানান, তার বোনজামাই মুন্সীগঞ্জ থেকে সকালে ঢাকায় আসার কথা। এখনও তার কোন সন্ধান পাননি। সিদ্দিক নামে এক যুবক জানান, তার মামা কালাম নিখোঁজ। তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। লঞ্চডুবির সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে ষাটোর্ধ নারায়ণগঞ্জের মোঃ সেলিম। তার ভগ্নিপতি মনির হোসেনের (৫০) লাশ খুঁজে না পেয়ে পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটছে। একবার লাশের স্তূপের কাছে গিয়ে তার ভগ্নিপতিকে খুঁজে পাচ্ছে না। সকালে এই লঞ্চে করে তিনি ঢাকায় আসছিলেন। লঞ্চডুবির পর থেকে তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সকাল থেকে তার ফোন বন্ধ। অপরদিকে মুন্সীগঞ্জের শাকিল তার ভাগিনার লাশ শনাক্ত করেছেন। কান্নারত অবস্থায় তিনি বলেন, আমার ভাগিনা নিয়মিত মুন্সীগঞ্জ থেকে ইসলামপুরে আসতেন। আজকের লঞ্চ দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। আমরা তার লাশ শনাক্ত করেছি। মর্গে ছুটে আসে নিখোঁজ ফল ব্যবসায়ী আবু সাঈদের স্ত্রী নূর জাহান বেগম। তার স্বামীকে খুঁজে ফিরছেন। তিনি জানান, ফল ব্যবসায়ী আবু সাঈদ মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাটের বাদামতলী থেকে ফল কেনার জন্য বাসা থেকে সকাল ৭টায় রওনা হন। পরে মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে লঞ্চে ওঠেন। আবু সাঈদের কোন খবর পাচ্ছেন না তার স্বজনরা। আবু সাঈদের স্ত্রী নূর জাহান বেগম জানান, অভাবের সংসার। করোনায় অনেকদিন ফলের দোকান বন্ধ। আয় নেই। এখন আবার ব্যবসা শুরু হয়েছে। আমার স্বামী ফল কেনার জন্য ঢাকায় আসেন। সকাল সকাল লঞ্চ ধরতে হবে বলে খেয়েও আসেননি। এই কথা বলেই কেঁদে ফেলেন নূর জাহান। লঞ্চ দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা সব লাশ রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। স্বজন হারানোর বেদনায় মিটফোর্ডের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোমবার সকালে লঞ্চডুবির পর পরই ডুবে যাওয়া যাত্রীদের উদ্ধার করতে নামে ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার ডুবুরিরা। উদ্ধারকাজ শুরুর পরপরই ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করে আনা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংখ্যাটি বেড়ে হলো ১৬। এরপর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। আবারও কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ল লাশের মিছিল। তুলে আনা হলো আরও লাশ। তবে ভয়াবহ এই ঘটনার ভিডিও বেরিয়েছে এরই মধ্যে। তাতে দেখা গেছে, এই মর্মান্তিক দৃশ্য। ঘটনার পর ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থেকে সংগ্রহ করা হয় ওই ভিডিও। ইতোমধ্যেই এটি ভাইরাল হয়ে গেছে। দেখে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছেন অনেকে। বুড়িগঙ্গা নদীর কেরানীগঞ্জের ফরাশগঞ্জ ঘাটে কুমিল্লা ডক এরিয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে আটজন নারী, তিনজন শিশু এবং ১৯ পুরুষ রয়েছেন। এছাড়া অভিযুক্ত লঞ্চ ময়ূরের চালক পলাতক রয়েছেন। ময়ূর সদরঘাট লালপট্টি থেকে চাঁদপুরের দিকে যাচ্ছিল।
×