ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মাহবুব লিটু আরিফুর রহমান

বাজেটে শিক্ষা খাতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৩০ জুন ২০২০

বাজেটে শিক্ষা খাতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

এবার জাতীয় বাজেট এমন এক সময়ে দিতে হয়েছে, যখন এক অদৃশ্য শত্রুর কবলে বিশ্ব । প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। কর্মহীন বেকার অসহায় মানুষের আর্তনাদ ধরিত্রীজুড়ে। বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। ইতিহাসে এমন করুণ পরিস্থিতি আর দেখেনি বিশ্ববাসী। এমন বৈরী সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে। বাজেটের মধ্যে নিহিত আছে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ইঙ্গিত, রয়েছে করোনার ভয়াবহতায় থমকে যাওয়া দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আবারও সচল করার প্রয়াস। তাই চ্যালেঞ্জিং এই বাজেটকে আমরা ‘করোনাকালীন বাজেট’ বলতে পারি। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাজেটে স্বাস্থ্য খাত ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বেশ কিছু খাতে করোনার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হলেও, করোনাকালীন সময়ে দেশের প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থীর ‘শিখন ক্ষতি’ পূরণে তথা করোনার ভয়াল থাবা থেকে শিক্ষা খাতের পুনরুদ্ধারে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বৈশ্বিক গবেষণায় শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে সবচেয়ে উত্তম বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। দীর্ঘমেয়াদী হলেও, অর্থনৈতিক গবেষণায় স্বীকৃত যে, এ খাতে বিনিয়োগে লাভের হার সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের চেয়েও বেশি। কিন্তু এ সত্যটি হয় আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি, নয়ত ‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও’- এই মানসিকতায় শিক্ষা খাতের বরাদ্দে তেমন মনোযোগী হচ্ছি না। বিগত বেশ কয়েক বছরের মতো এবারও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেশি দেখানোর জন্য অন্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৮৫,৭৬২ কোটি টাকা অর্থাৎ, মোট বাজেটের ১৫.১০% বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার মতো এত বৃহৎ সেক্টরকে অন্য খাতের সঙ্গে যুক্ত করে বাজেট দেখানোর মধ্যেই কিন্তু সুপ্তভাবে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বহীনতার চিত্রই ফুটে ওঠে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ৭৯ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও তা ছিল মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ মিলিয়ে ৬৬৪০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, শিক্ষা খাতে প্রকৃত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১.৬৯ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় মাত্র .০১ শতাংশ বেশি দেখা গেলেও মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় আনলে দেখা যায় আসলে আগের তুলনায় বরাদ্দ কমে গেছে। আবার জিডিপির দিক দিয়েও যদি বিবেচনা করা যায় তাহলে দেখা যায় আগামী অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২.৭০ শতাংশের সমান, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ২.৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে তা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কম। অথচ ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করে আসছে। এর মানে আমরা এই করোনাকালে শিক্ষা খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তেমন গুরুত্ব দেইনি। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দ কাক্সিক্ষত মাত্রায় না বাড়ালে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কেননা এসডিজির চার নম্বর লক্ষ্যে শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলা হলেও এটিই মূলত অন্যান্য লক্ষ্য পূরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরী। এবারের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার জন্য বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, যা বিদ্যমান বাজেটের তুলনায় ৯০০ কোটি টাকা বেশি। এবারের বাজেটে মাত্র ৫০৩টি স্কুলে ইন্টারএ্যাক্টিভ ক্লাসরুমের কথা বলা হয়েছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। আশার কথা প্রতিটি প্রাইমারী স্কুলে ইন্টারনেট সরবরাহ ও দুটি ল্যাপটপ ও দুটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এগুলোর ব্যবহার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ বা টেকনিশিয়ার নিয়োগের কথা বলা হয়নি। এর আগে স্কুলগুলোতে কম্পিউটার বরাদ্দ দেয়া হলেও এমন অনেক নজির আছে যে, ব্যবহার না হতে হতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। তাই উপকরণ সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তা অপচয় বৈ কিছু নয়। বাজেটের খুব ভাল একটি দিক হচ্ছে প্রাইমারী স্কুলকে আরও বেশি একীভূত শিক্ষার কাছাকাছি নেয়ার জন্য হুইলচেয়ার, ক্রাচ, হিয়ারিং এইড ইত্যাদি সরবরাহের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য তাদের নিজস্ব ভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং ওই ভাষায় দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রোফাইল প্রস্তুতকরণ, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, স্কাউটিং সম্প্রসারণ ইত্যাদিও ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। এই বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যই কেবল সহায়ক হবে না, ঝরে পড়ার হার রোধের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদিত ন্যাশনাল স্কুল মিল পলিসি ২০১৯ এর অধীনে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল দেয়ার জন্য ২৪৫ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৩৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অথচ এবার করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা যেভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, এবার এই খাতে আরও বেশি বরাদ্দ রাখা আবশ্যক ছিল। বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা বর্তমান অর্থবছরে ছিল ২৯৬২৪ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, অর্থবছরে ছিল ৭৪৫০ কোটি টাকা। এই বরাদ্দের বেশিরভাগই ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয়, প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতাদি ইত্যাদির জন্য ব্যয় হবে। তবে এবার সবচেয়ে বেশি জরুরী ছিল বেসরকারী কিন্ডারগার্টেন, স্কুল এবং কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। করোনার কারণে বিগত কয়েক মাস ধরেই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীগণ বেতন পাচ্ছেন না। তারা লজ্জায় ত্রাণের লাইনেও দাঁড়াতে পারছেন না। পার করছেন দুর্বিষহ জীবন। তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার কথা সরকারের বিবেচনা করা উচিত। তা ছাড়া এখনো অনেক নন-এমপিও শিক্ষক আছেন, যাদের এমপিও এর আওতায় নিয়ে আসা সময়ের দাবি। তবে বাজেটের খুব ভাল একটি দিক হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যেমে গরিব ও মেধাবী ৫ লাখ ৫৭ হাজার ছেলে শিক্ষার্থী ও ১০ লাখ ৯৫ হাজার নারী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং এক লাখ ১৬ হাজার পুরুষ ও ৪ লাখ ৬২ হাজার নারী শিক্ষার্থীকে উচ্চমাধ্যমিকে বৃত্তি দেয়া হবে। করোনার কারণে গরিব শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে এই ফান্ড সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এবারের বাজেটে উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে তেমন কোন বৈচিত্র্য নেই। গত বাজেটে উচ্চ শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে যে ৪২টি প্রজেক্টের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, এ বছর পাঁচটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রজেক্ট বাদে বাকি ৩৭টি প্রজেক্টের বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বরাবরের মতো এবারেও বাজেটে গবেষণার বিষয়টি আলাদা কোন গুরুত্ব পায়নি। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পাচ্ছে না। অথচ দেশে খুব ভাল মানের অনেক গবেষক আছে। যদি যথোপযুুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যায়, তবে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনেক ভাল মানের গবেষণা হবে। সংশোধিত বাজেটে তাই বিভিন্ন খাতওয়ারি উচ্চ শিক্ষার গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত। সেই সঙ্গে বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিংয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এবারের বাজেটেও শিল্পবিপ্লব ৪-কে টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের জন্য যে চৌকস ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা প্রয়োজন, সেই বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য ইউজিসি থেকে অনলাইন শিক্ষা প্রসারের জন্য তাগিদ দেয়া হলেও বাজেটে এর তেমন প্রতিফলন ঘটেনি। অথচ অনলাইন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাগ্রে যেসব শিক্ষার্থীর কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন নেই সেসব উপকরণ ফেরত দেয়ার শর্তে সরবরাহ করার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার ছিল। সেই সঙ্গে মোবাইল ডাটার খরচ কমানো উচিত ছিল। বাজেটে উল্টো মোবাইল ডাটার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে, যা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের অন্তরায়। তাছাড়া শিক্ষকদের ভার্চুয়াল পেডাগজির প্রশিক্ষণসহ উপকরণাদি সরবরাহ করার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করার দরকার ছিল। লেখক : ড. মাহবুব লিটু, সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরিফুর রহমান, প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×