ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

বাজেট ভাবনায় পল্লী অর্থনীতি

প্রকাশিত: ২০:৩০, ৩০ জুন ২০২০

বাজেট ভাবনায় পল্লী অর্থনীতি

বিগত ১১ জুন ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের এযাবত কালের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট পেশ করেন বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী। যাকে বলা হয় করোনাকালের বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম হলো করোনাকালে জনগণকে স্বস্তিতে রাখা, বিশেষত স্বাস্থ্য, কৃষি তথা খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে, সামাজিক সুরক্ষার খাতের পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি। তা ছাড়াও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা, উত্তরণ এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০২১, এসডিজি ২০৩০ বাস্তবায়ন ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এর লক্ষ্য সামনে রেখে যথাক্রমে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে উত্তরণের অনুষঙ্গ হিসাবে, যেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও (৮.২%) লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ সঙ্কট উত্তরণ আগামী জুলাই-আগস্টে সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জুন ২৮ পর্যন্ত মোট সংক্রমিত ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪০ হাজার ৭৮৭ জন এবং মোট মৃত্যু ১৭৩৮ জন। এ সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে এবং এটি না কমলে বাজেট বাস্তবায়ন দূর হবে না। বিশ্বব্যাংক গ্লোবাল ইকোনমিক প্রস্পেকটাস ২০২০ প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে ৮০ বছরের মধ্যে সময়ে বেশি মন্দায় পড়বে বিশ্ব, ৭ থেকে ১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যতায় পতিত হবে এবং বর্তমান বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৬ শতাংশ হতে পারে। তবে আমরা কিছুটা আশাবাদী হতে পারি, যেহেতু গত জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেহেতু বছর শেষে ৩০ জুন, ২০২০ পর্যন্ত ৪% প্রবৃদ্ধি হতে পারে। অনুন্নয়ন-উন্নয়ন মিলে কেবল কৃষি খাতে যে ব্যয ধরা হয়েছে, তা নিয়ে অনেক কৃষি অর্থনীতিবিদ আপত্তি করেছেন বিশেষত পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে কৃষি খাত। যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য পত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তাই এই খাতের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন জড়িত, যা বাজেট বক্তৃতায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। কারণ দেশে আবাদযোগ্য জমি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ায় পরও সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল ও কর্মসূচী গ্রহণের ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বেড়েছে, কৃষি ভর্তুকি, সার-বীজ-সেচ-সুবিধা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, শস্য বহুমুখীকরণ ও বিপণন অব্যাহত রাখার ঘোষণা এসেছে। এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে দেশে পরিবেশবান্ধব জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওনোর উপযোগী কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার। গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং হস্তান্তর কাজ চলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খরা লবণাক্ত তাপ সহিষ্ণু ধান-গমের জাত উদ্ভাবনসহ সম্প্রসারণ হচ্ছে, অর্থকরী ফসল পাটের বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, বহুমুখী পাটপণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে, মৎস্য খাতে দেশ অনেক এগিয়েছে ইত্যাদি। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, করোনার বাস্তবতা মেনে নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করণের লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে আগামী বাজেট, যেখানে কৃষি নীতি ২০১৮, ভিশন ২০১১ ও ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পবিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে প্রণয়ন করেছে কর্মপরিকল্পনা ২০২০, বিশেষত সকলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেমন সাবেক কৃষিমন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, রফতানিকারক সমিতি ও কৃষি ব্যবসায়ী। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে যেমন হারভেস্টার, রিপার, ট্রান্সপ্লান্টার, ট্রাক্টর ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রণোদনা রাখা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় কৃষক পাবেন বিরাট ভর্তুকি। যেমন, হাওড়ের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলের জন্য ৫০ শতাংশ। চলতি বছরে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে যান্ত্রিকীকরণের খাতে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা এবং আগামী বছরে সারের ভর্তুকি বাবদ ৭০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে। চলতি বছরে কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতে ১২০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে আগামীতে ৩০০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক ইঞ্চি জমিও যাতে পতিত না থাকে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। বিএডিসি/ডিএইএর মাধ্যমে বাগানবাড়ি, বসতবাড়ি, শহরে কৃষি সম্প্রসারণে ৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে বীজ ও চারা বিতরণসহ কৃষি পরামর্শ কাজে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়াতে চলতি বছরে বরাদ্দকৃত ৬৭.৮৪ থেকে বাড়িয়ে আগামী বছরে ১৩১.৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষি উদ্যোক্তা, এসএমই ও কৃষি ব্যবসায়ীদের ৪ শতাংশ হারে ঋণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা-যা উৎপাদন, প্রসেসিং ও বিপণন কাজে সহজ শর্তে বিতরণ করা হবে। আগামী অর্থবছর থেকে সকল কৃষি প্রণোদনা ও ঋণের অর্থ সরাসরি কৃষকের ব্যাংক হিসেবে প্রেরণ করা হবে। আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হবে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষি ঋণ দেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা, দেশীয় পেঁয়াজ রক্ষার্থে পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক বসবে, কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ব্যাপক হারে হ্রাস করা হবে, সার-বীজ-কীটনাশকে শূূন্য শুল্ক হার অব্যাহত থাকবে এবং ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ায় কৃষক লাভবান হবে। এবারকার প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি সহায়ক যে পদক্ষেপগুলোর ঘোষণা এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে সরকারের ১০.৬ শতাংশ বরাদ্দ, যাকে সাধুবাদ জানাই। প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে বাজেট আসে বাজেট যায়। অথচ গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী অগণিত গ্রামীণ পরিবার কৃষক-অকৃষক তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন আশানুরূপ হয় না। যদিও আগের তুলনায় পল্লী অঞ্চলের রূপান্তর হয়েছে সমাজ কাঠামোতে, অবকাঠমোতে ও মানুষের মূল্যবোধ তথা নৈতিকতায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কৃষি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় মূল কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। যেমন, এই বছরে বোরোতে বাম্পার ফলন হওয়ায় পরও চাল ভারত থেকে আমদানি করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাষী। এখন বাজেট কাঠামোতে এমন ঘোষণা আসতে পারে না যে কৃষক তার পণ্য নিয়ে আর কোন সময় বিপাকে পড়বে না কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এটি কেবল শস্যভিত্তিক কৃষির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যা মৎস্য কিংবা পোল্ট্রির কিংবা ডেইরির ক্ষেত্রে দেখা যায়। কৃষি উনন্নয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ঘটাতে হলে কৃষকের স্বার্থকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান সরকারের কৃষি বাজেটে যে সকল প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার সফল বাস্তবায়নে সময় পাওয়া যাবে জুলাই ২০২০ থেকে জুন, ২০২১ পর্যন্ত। এখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সেবা সাহায্য, সহযোগিতা ও ভর্র্তুকি সরাসরি উদ্দিষ্ট কৃষক ও প্রান্তিক চাষীদের কাছে পৌঁছানোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, যা উৎপাদনবান্ধব ও পরিবেশ উপযোগী বলে বিবেচিত। উল্লেখ্য, কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবা সহায়তা প্রদান (প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষ) বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমালেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় এবং এটি একটি অগ্রাধিকার খাত হিসেবে এখনও বিবেচিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও যাদের জন্য এ সহায়তা তাদের কাছে কতটুকু পৌঁছে তা নিয়ে। বিষয়টি একাধারে যেমন প্রশাসনিক অপরদিকে রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ। ইতিহাসে দেখা যায় কৃষি ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত সার্বিক কাজটি সরকার কর্তৃক পরিচালিত হতো। কিন্তু সময়ের আবর্তে ’৮০-এর দশক থেকে বাজার অর্থনীতির আগমনের ফলে বেসরকারী উদ্যোগ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। এ দুটি সময়ের কার্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, বেসরকারীকরণ বাজারে অসম প্রতিযোগিাতার জন্ম দেয় এবং এ অবস্থা থেকে কৃষি সেবা ও উপকরণ ক্রয় করে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীদের পক্ষে চাষাবাদ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চাহিদার তুলনায় উপকরণ সরবরাহ কম থাকায় এবং সার্বিক বিপণন ব্যবস্থার ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এর সুযোগ গ্রহণ করে লাভবান হতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকে বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাত (শস্য)-এর অবদান কমে দাঁড়ায় ১০.৭ শতাংশ এবং কৃষিতে (শস্য) প্রবৃদ্ধির হার ০.৯ শতাংশ, যা আগের সময়ে গড়ে ছিল ৩.৬ শতাংশ এবং ৫.৭ শতাংশ। তা ছাড়াও জৈব প্রযুক্তির ঘাটতির ফলে মাটির উৎপাদন শক্তি অনেকাংশে কমে যায়। এ সমস্যগুলো যেমন এক দিনে সৃষ্টি হয়নি, তেমনি এর সমাধানও একদিনে সম্ভব নয়। তবে বর্তমান সরকার তাদের সময়কালে জাতীয় সংসদে যে কয়টি বাজেট উপস্থাপন করেছে তার প্রত্যেকটিতে তুলনামূলক বিচারে কৃষিকে ও পল্লী উন্নয়নকে প্র্রাধান্য দেয়া হয়েছে । বর্তমান সরকার ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের জন্য মোট ৩৯,৫৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। যার মধ্যে উন্নয়ন খাতে রয়েছে ২৫.৪ শতাংশ, যা পল্লী উন্নয়ন খাতের মোট বরাদ্দের ৬১.০১ শতাংশ । আবার সার্বিক বাজেটের আলোকে পল্লী উন্নয়ন খাতকে বরাদ্দের ভিত্তিতে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সার্বিক অনুন্নয়ন বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ১.৫ শতাংশ এবং তার সঙ্গে যদি কৃষি খাতকে যোগ দেয়া যায় তা হলে ৩.৯ শতাংশ দাঁড়ায়। অপরদিকে সার্বিক উন্নয়ন বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৮.৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে যাদি কৃষি খাতকে যোগ দেয়া যায় তাহলে মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৫.৪ শতাংশ। তা ছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার আগামী বছরের বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখেছে, যা ২৬,৭৪২ কাটি টাকা, যা উন্নয়ন বাজেটে ৪.৫ শতাংশ এবং অনুন্নয়ন বাজেটে ৬.১ শতাংশ। এই খাতে থেকে পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী অনেকেই সরাসরি উপকৃত হবে। এর মধ্যে আছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী যথা বৃদ্ধ ভাতা, প্রতিবন্ধী, এসিড দগ্ধ, তালাকপ্রাপ্তা, মাতৃত্বজনিত ছুটি ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, কাবিখা, বিজিএফ, বিজিডি, অতি দরিদ্র্যদের জন্য কর্মসূচী, আশ্রয়ণ প্রকল্প, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ, গৃহহীনদের গৃহনির্মাণ প্রকল্প, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন প্রকল্প ইত্যাদি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার এখনও প্রধান বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং পল্লী উন্নয়নের কথা এলেই কৃষি সবার আগে চলে আসে। বর্তমানে কৃষি খাতের হার জিডিপিতে প্রায় ১৪% এবং কৃষি জিডিপিতে শস্য খাতের অবদান সর্বাগ্রে রয়েছে। যেহেতু কৃষি পল্লী উন্নয়নের একটি বড় খাত, তাই সরকার বাজেটে কৃষি খাতে ২০ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা আগামী বছরের বাজেটে প্রস্তব করেছে। ব্যাপক অর্থে পল্লী উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা উন্নয়ন বাজেটের ২৯.৬ শতাংশ এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ২০.২ শতাংশ বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে উল্লেখ্য, কৃষি যেহেতু একটি অগ্রাধিকারভুক্ত খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টির এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই গত বছরগুলোতে এই খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৩২ হাজার ৫০২২ কোটি টাকা, যা গড়ে প্রতি বছর দাঁড়ায় ৬৫০১.৪ কোটি টাকা। করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটকে পাল্টে দিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় ২০০৫-২০১০ পর্যন্ত প্রতি বছর দারিদ্র্য ১.৭ শতাংশ হারে কমলেও ২০১০-২০১৬ কালে তা কমেছে ১.২ শতাংশ হারে এবং ২০১৬ পরবর্তী তিন বছরে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি ছিল নিম্নমুখী। শ্লতগতিতে হলেও দারিদ্র্য যখন হ্রাস পাচ্ছিল, তখন চলতি বছরে কোভিড-১৯ করোনা এসে সব পাল্টে দেয়। বাজেট ঘোষণার আগে PPRC & BRAC-এর গবেষণার ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘটেছে, যেখানে বলা হয়েছে কোভিড-১৯ এর কারণে দেশে নতুন করে ২২.০৯ শতাংশ মানুষ গরিব হয়েছে। বিআইডিএসএর গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে করোনার প্রভাবের ফলে দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। সরকার দেশের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে পল্লী অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য বদ্ধপরিকর এবং এরই মধ্যে অনেক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এ মহতি উদ্যোগের বাস্তব প্রয়োগ এবং এর মাধ্যমে সার্বিক কর্মসূচীর সুফল আনয়নে আরও বাস্তবভিত্তিক প্রদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পল্লী প্রশাসনকে কৃষকের/ অকৃষকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের হাতে সেবা পৌঁছানোর নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত কৃষকের জন্য ১০ টাকা মূল্যের ব্যাংক হিসাবসহ কৃষি কার্ডের মাধ্যমে সাহায্য সহয়োগিতার বর্তমান অবস্থা আরও জোরদার করণ; দ্বিতীয়ত দরিদ্র কৃষক কর্তৃক কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে ইউসিসিএকে কেন্দ্র করে প্রতিটি গ্রাম সমবায়ের আওতায় কৃষি পণ্যের সমষ্টিগত বিপণন ব্যবস্থা ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ গড়ে তোলা যায়; তৃতীয়ত চাষাবাদ, পশু পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত নতুন প্রজাতি সম্পর্কে ধারণা, চতুর্থত হর্টিকালচার, পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, বনায়ন, মৌমাছির চাষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বীকৃত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে সফলভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রত্যেক কৃষি কর্মীকে সেবা প্রদানের স্বার্থে কৃষি ভর্তুকির অংশ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ একটি করে কিট বক্স সরবরাহ করা যেতে পারে; পঞ্চমত কৃষি উপকরণের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সরকারী সেবাদান প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের একটি সহযোগী সুস্থ প্রতিযোগিতার আবহ গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং বেসরকারী খাতকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দেয়ার জন্য চাষীবান্ধব একটি প্রশাসনিক উদ্যোগ কৃষি ভর্তুকির অর্থে গ্রহণ করা যায়। সরকার ঘোষিত কৃষি সেবা কর্মসূচীকে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার, এনজিও, সিভিও, এসএসও, সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদসহ সকলকে একযোগে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। তবেই বাজেটে প্রস্তাবিত ভর্তুকির জন্য প্রণীত লক্ষ্য অর্জন অনেকাংশে সহজ হবে। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা [email protected]
×