ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৭৮ প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মুখে লাখ লাখ কর্মী এখন বেকার প্রণোদনায় বরাদ্দ ২৪ হাজার কোটি টাকা

করোনার কবলে এসএমই খাত

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৯ জুন ২০২০

করোনার কবলে এসএমই খাত

এম শাহজাহান ॥ করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে দেশের এসএমই খাত। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এই খাতে ৭৮ লাখ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। করোনায় দেশী-বিদেশী বাজার বন্ধ থাকায় এইসব পণ্যের চাহিদা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। বন্ধ হওয়ার উপক্রম অধিকাংশ শিল্প। সরকার বলছে, এই খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এ শিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ২৪ হাজার কোটি টাকা। সঠিক বণ্টন ও ঋণে পুনরুজ্জীবিত হবে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা এই খাত। প্যাকেজের সুফল নিশ্চিত করতে এসএমই ডাটাবেজ আপডেট করার ঘোষণা দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্যাকেজের আওতায় রেটিং ছাড়াই এসএমই খাতের গ্রাহকদের ঋণ বিনিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নানা বাহানায় ব্যাংকগুলো সহজ শর্তের ঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে। করোনা সঙ্কট উত্তরণে এসএমই খাত দ্রুত চাঙ্গা করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চামড়া ও পাটজাতপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, ট্রাভেল ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, ফ্যাশন পণ্য, হস্ত ও কারু শিল্পপণ্য, উপহারসামগ্রী, শাড়ি, থ্রিপিস, ফতুয়া, বেডশিট, বালিশের কভার, বিভিন্ন বুটিকসামগ্রী, শোপিস. বাঁশ- বেতের পণ্য উৎপাদনকারী ছোট শিল্পগুলো সাধারণ এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের প্রায় ৭৮ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে সারা দেশে। এসব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিপণি বিতানে, ব্র্যান্ডশপে এসব খাতের প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য সরবরাহ করে থাকে। আবার ফেসবুক বা ওয়েবসাইট খুলে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা হয়। করোনার কারণে তাদের বেচাকেনাও বন্ধ। এছাড়া মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর ব্যবসায়ী এবং এ খাতের খাদ্য ও ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোও সমস্যায় পড়েছে। অনেকে পণ্য পৌঁছতে পারছেন না। আবার অনেকে পণ্য তৈরি করতে পারছেন না। এতে খামারিরা যেমন খাদ্য, ওষুধ পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন, আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে লোকসানে। আবার সবকিছু বন্ধ থাকায় দোকানদার, হোটেল- রেস্তরাঁ ব্যবসায়ীরাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বেচাকেনা না থাকায় ঘর ভাড়া ও কর্মীদের বেতন, ঋণের সুদ পরিশোধ নিয়ে তারাও চাপে আছেন। রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের শাড়ি ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনি তার ভাইসহ মোট সাতজন এ দোকানে বসেন। নিজেদের ও চার কর্মীর পরিবার চলে দোকানের আয়ে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা দুর্যোগে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে অনেকে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বেন। এজন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের পাশে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসএমই খাতের প্রায় ৭৮ লাখ শিল্প প্রতিষ্ঠান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পোন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে উৎসাহিত করা হচ্ছে এই খাত। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে এই খাত সম্প্রসারণে উৎসাহ দিচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অন্যের জন্য সমানতালে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। বর্তমান মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪৬ হাজার ২৯১টি উৎপাদন ইউনিট রয়েছে। এরমধ্যে ৮৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। বর্তমানে দেশের উৎপাদন খাতের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং এ শিল্পের সঙ্গে ১৩ লাখ ৯১ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজে দেশের কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুজ্জীবিত ও অর্থনৈতিক গতি সঞ্চারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে নি¤œ আয়ের পেশাজীবী কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃ অর্থায়ন স্কিম ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সিড মানি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সব মিলিয়ে প্রায় ২৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ পাবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। এছাড়া সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের এপ্রিল-মে ২০২০ মাসে স্থগিতকৃত ঋণের আংশিক সুদ মওকুফ বাবদ সরকার ভর্তুকি বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে। এই সুবিধারও বড় অংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, করোনা সঙ্কট থেকে অর্থনীতি পুনর্গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টর এবং দরিদ্র অসহায় মানুষের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার অধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৭ ভাগ। তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১৯টি আর্থিক সহায়তা ও প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ সম্বলিত কার্যক্রম যার মধ্যে রয়েছে বৃহৎ শিল্প এবং কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহের লক্ষ্যে সুদ, ভর্তুকি প্রদান। এছাড়া দেশের অসহায় ও অতি দরিদ্রকে সহায়তা দিতেও প্যাকেজে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসএমই ডাটাবেজ দ্রুত আপডেট করা হবে ॥ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল নিশ্চিত করতে এসএমই ডাটাবেজ দ্রুত আপডেট করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সহায়তা এসএমই ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এই ডাটাবেজ আপডেট করবে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা প্রণোদনার সুফল পাবেন। রেটিং ছাড়াই এসএমই ঋণ ॥ করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রেটিং ছাড়াই এসএমই খাতের গ্রাহকদের ঋণ বা বিনিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসএমই এ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট থেকে এ বিষয়ে জারি করা একটি নির্দেশনা দেশের সব তফসিলী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে দাফতরিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ায় ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকের গাইডলাইনস ফর ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম (আইসিআরআরএস) এর মাধ্যমে গ্রাহকের রেটিং কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় মাঝারি শিল্পের আওতায় তাদের উৎপাদন বা সেবা কার্যক্রম পুনরায় দ্রুত চালু করার লক্ষ্যে শুধু আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে আইসিআরআরএস অনুযায়ী রেটিং কার্যক্রম সম্পাদন না করেই ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সুবিধা দেয়া যাবে। তবে, প্রতিটি ব্যাংক বিদ্যমান নিজস্ব নীতিমালার আওতায় ঋণ ঝুঁকি বিশ্লেষণপূর্বক ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রাহক নির্বাচন করবে। তবে, এর আগে জারি করা নির্দেশনানুযায়ী খেলাপী ঋণ গ্রহীতারা এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা পাবেন না।
×