ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতির ক্রান্তিকালে ভরসা দেয় যে নেতৃত্ব

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৯ জুন ২০২০

জাতির ক্রান্তিকালে ভরসা দেয় যে নেতৃত্ব

ঐন্দ্রজালিক কোন ব্যাপার নয়। নয় অতি বিস্ময়ের কিছু। তিনি এমনই। তাঁর নেতৃত্বের এটিই যেন খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিপর্যয়ে বিজলী চমকানো নেতৃত্বের অধিকারী তিনি। জাতির ক্রান্তিকালেই ভরসার কান্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ মুহূর্তেই তাঁকে বিশেষভাবে চেনার সুযোগ পায় এদেশের মানুষ। সতেরো কোটি মানুষের চৌত্রিশ কোটি চোখ তাকিয়ে দেখে কতটা নির্ভীক তিনি। তিনি আশার বাতিঘরও। সকল দুর্যোগেই স্পষ্ট হয়েছে তাঁর গৃহীত একেকটি পদক্ষেপ কতটা দৃঢ়। বিরূপ পরিস্থিতিতে লাখো কোটি মানুষকে আশ্বস্ত করে, অভয় দিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে তুলনা করতে গেলে এই মুহূর্তে দেশে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য বহু আগে থেকেই বিশ্ব গণমাধ্যম এমন বিশ্লেষণ করছে। বিভিন্ন রেটিং এজেন্সিতে তাই বলতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি সব সময় সহজ সরল পথে চলেছে এমনটা বোধ করি কোন গবেষকই জোর গলায় বলতে পারবেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে পুরনো পাকিস্তানের ধারায় চালিয়েছে সামরিক শাসকরা। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তানী আদর্শের রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। আশির দশকের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ও রাজনীতির উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামিরক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ দুর্যোগের মধ্যে দিয়েই জাতির হাল ধরতে আবির্ভূত হওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা তার জন্য। গ্রেনেডের মুখ থেকে জীবন নিয়ে ফেরা এক বহ্নিশিখার নাম- শেখ হাসিনা। তাঁর জীবন বাংলার মেহনতী দুঃখী মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। মানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির দর্শন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে যেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেরও প্রতিরূপ তিনি। শেখ হাসিনার রাজনীতির মূলমন্ত্র হলো ‘জনগণের জীবনমান উন্নত করা।’ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ক্লক বলছে, সারা দুনিয়ার প্রায় পৌনে ৮ শ’ কোটি মানুষ এখন যুদ্ধপরিস্থিতিতে। যেখানে বাঁচা-মরা নিয়ে সংশয় সবার। এটি এমন একটি যুদ্ধ যে সর্বাধুনিক সমর শক্তির দেশ যাদের মাতব্বরীতে গোটা বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থা তছনছ হয়েছে, যারা শত হাজার পারমাণবিক বোমা, ফাইটার জেট, সাবমেরিন, বিভিন্ন রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্রের মালিক তারাও যারপরনাই অসহায় এক অদৃশ্য জীবাণু দানবের কাছে। চারদিকে কেবল লাশের মিছিল। তাদের সকল শক্তিই আজ অকেজো। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী করোনা মহামারীতে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রাণ গেছে সবচেয়ে বেশি মানুষের। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। এরপর স্পেনে করোনা আক্রান্ত ও মৃত মানুষের মিছিল। এরপরপরই ইতালিতে। একইভাবে ফ্রান্সে জার্মানিতে, এমনকি রাশিয়াতেও আক্রান্তের সংখ্যা অনেক। এশিয়ার সব দেশ এই ভাইরাসের সঙ্গে দিন-রাত যুদ্ধ করছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এবং এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস কাউকেই যেন ছাড় দিচ্ছে না। বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রজেকশনে বলা হচ্ছে আফগানিস্তান এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে যদি সহযোগিতার হাত না বাড়ানো হয় তবে একশ’ কোটি মানুষ এই ভাইরাসের কবলে পড়তে পারে। এরইমধ্যে বৈশ্বিক সংক্রমণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। তেমন কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় লাগাম টানতে কেবল ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে কয়েক দফায় মানব শরীরে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে চারপাশটা দেখে, পড়ে শুনে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, ভ্যাকসিন তৈরির সুখবর নানা খবর জানা গেলেও নিকট ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন ব্যবহারর ইঙ্গিত মিলছে না। গেল ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান মেলে। সেই থেকে বিশ্বের আন্যন্য দেশের তুলনায় আজ অবধি আমাদের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ও সংক্রমণের খবর জানাচ্ছে রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। গত বছরের ডিসেম্বরে উহান সংক্রমণের পর থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী যখন ভয়ানক রূপ নিতে শুরু করে করোনাভাইরাস, তখনই চালকের আসনের নিয়ন্ত্রণ নেন বিশ্বের এক দুর্যোগপ্রবণ দেশের অন্যতম দক্ষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপক- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত, কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খোলা রেখে সরকারী সকল অফিস-আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি, গার্মেন্টস বন্ধ, নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করতে বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাসদস্য মোতায়েন, গরিব, ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে ত্রাণ সহায়তা জোরদার, করোনা শনাক্তে পরীক্ষা জোরদার, হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন, দুর্যোগে প্রথম সারির যোদ্ধা চিকিৎসক ও নার্সদের অনুপ্রেরণা যোগানো- এসব কাজই তিনি করে যাচ্ছেন- একা। অবশ্যই তার টিম আছে। একা বলছি এই অর্থে যে, যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির ভূমিকাই মুখ্য হয়ে থাকে। এটাই নিয়ম। এর আগে প্রধানমন্ত্রী দু’দফায় ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য। পরে বোধ করি, তা এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি করোনা বাজেটে রূপ নেয়। অন্যরা যখন স্বেচ্ছায় নিভৃতবাসে তখন নিজের কার্যালয় খোলা রেখেছেন, করোনা মোকাবেলার কর্মযজ্ঞ নিজ হাতে সমন্বয় করে চলেছেন নির্ঘুম শেখ হাসিনা। অনেকটা নিয়মিতভাবেই সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্দেশনা দিতে দেখে আশ্বস্ত হয়েছে দেশের মানুষ। ভিডিও কনফারেন্স চলে এশীয় নেতৃত্বেও, সঙ্গে কোভিড মোকাবেলা করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে সুরক্ষিত রাখার প্রত্যয়ে কৌশল নির্ধারণেও। বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য যে, এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার মতো ভিশনারি, কর্মঠ ও নিরেট সৎ এমন বিরল নেতা পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের বা উন্নয়নশীল দেশে একজন শেখ হাসিনার মতো নেতা কিভাবে দেশের কা-ারির ভূমিকায় আসতে পারে তা শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব না দেখলে হয়তো কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এক হয়ে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ভিয়েতনামে কত শত মানুষ মেরেছে তার কোন হদিস নেই। সেই পরাক্রমশালীরা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে করোনা মোকাবেলায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছেন তিনি। খবরে জানলাম, লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের রাস্তায় নাকি লাশ আর লাশ পড়ে আছে। চীনে দিনের পর দিন জ্বলেছে ক্রিমেশন সেন্টারগুলো। কেবল মৃতদেহ পোড়াতে। আসলে কী হয়েছে তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন। তবে চীনের আকাশ তেমন প্রমাণই দিয়েছে বলে স্যাটেলাইটের তথ্যে ভর করে গণমাধ্যম এসব খবর দিয়েছে। এদেশে বলশালী পুঁজিপতিরা দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন; শ্রমিকের পাওনা দিচ্ছেন না; ত্রাণের চাল চুরি করছে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা- এমন সব খবরে যখন কান ভারি তখনই মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসার খবর এলো। ফোর্বসের নিবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৬ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষের দেশ বাংলাদেশ সমস্যা-সঙ্কটের সঙ্গে অপরিচিত নয়। তিনি এই সঙ্কট মোকাবেলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছেন, যাকে ‘প্রশংসনীয়’ বলছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।’ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র মাসুষের কাছে প্রতিজনকে ঈদের আগে নগদ আড়াই হাজার টাকা নিজ তত্ত্বাবধানে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই সহযোগিতা চলমান রাখবেন। করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রশংসা করে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে চীন থেকে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। মার্চের শুরুর দিকে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেন এবং জরুরী নয় এমন ব্যবসা-বাণিজ্য অনলাইনে পরিচালনার নির্দেশ দেন। এরপর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিং ডিভাইস বসান, যাতে কেউ করোনাভাইরাসের উপসর্গ বহন করছে কি না তা বোঝা যায়। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের স্ক্রিনিং হয়, যাদের ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। এগুলো এমন উদ্যোগ যা যুক্তরাজ্য এখনও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাঁর প্রশাসন সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তা কেবল মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতির পিতার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। তাঁর কাছে এদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ এ জন্য যে এই মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি সাহসের সঙ্গে করোনা মহামারী মোকাবেলা করছেন, কেননা তিনি ভয় পান না, তিনি জানেন কোন সময় কোন কাজটি করতে হবে। একই সঙ্গে সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাকা যেভাবে তিনি এগিয়ে নিচ্ছিলেন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সাধান করছিলেন, করোনা অতিমারী যাতে সেই গতি রোধ করতে না পারে সে জন্য আগাম ব্যবস্থাও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যুতের দাবিতে গুলি খেয়ে মরা মানুষগুলোর ঘরে বিদ্যুত দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করার পরও পদ্মা সেতু বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি। বিশ্ববাসীকে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ পারে। শুধু আন্তরিকতা বা সততাই শেখ হাসিনার শক্তি না। তিনি বিশ্বাস করেন আমরা পারি, বাঙালীরা পারে। শেখ হাসিনা বার বার একটি কথা বলেন, আমরা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি তাই কোন বিজয়ী জাতি কখনো মাথা নত করে না, হারতে পারে না। এই একটি মন্ত্রই শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র। একুশ শতকে এই মূলমন্ত্রই তাঁকে বিশ্বনেতা বানিয়েছে। করোনা জয় করে শেখ হাসিনা আরও একবার সেই সাফল্যের ধারা বৈশ্বিক অঙ্গনে সমুন্নত রাখবেন- এ বিশ্বাস আমার মতো আরও বহু কোটি মানুষের। লেখক : শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতি কর্মী ও গবেষক, উপ-উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
×