ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটানা সাড়ে ছয় ঘণ্টা মাটি টেনেছে কিশোরী তানিয়া

প্রকাশিত: ২২:১৫, ২৮ জুন ২০২০

একটানা সাড়ে ছয় ঘণ্টা মাটি টেনেছে কিশোরী তানিয়া

মিজানুর রহমান, শ্যামনগরের কাশিমাড়ি থেকে ফিরে ॥ হাতে মুখে আর সমস্ত শরীরজুড়ে নেইল কাদামাটির ছোপ। ভেজা কাপড়ে বেড়িবাঁধের ওপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা। ভোর ৬টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত একটানা মাটি টেনে রিং বাঁধ তৈরিতে সহায়তা করার পরও এই কিশোরীর মুখজুড়ে তৃপ্তির হাসি। বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের কাশিমাড়ির আমফানে ভেঙ্গে যাওয়া ঘোলা বেড়িবাঁধের রিং বাঁধ তৈরিতে গত ৩ দিন ধরে সে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে। ঘোনা প্রকল্প এলাকায় বাড়ি এই কিশোরী তানিয়ার (১৪) বাড়িতে মা অসুস্থ। বাবা জাহাঙ্গীর সংসারে থাকে না। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে তানিয়ার স্কুলপর্ব শেষ হয়েছে প্রায় ৩ বছর আগে। এরপরও বাঁধভাঙ্গা পানি থেকে বাঁচতে আর এলাকাবাসীকে বাঁচাতে তানিয়া হাজার হাজার এলাকাবাসীর সঙ্গে নেমেছে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। তানিয়া টেকসই বাঁধের মানে বোঝে না। তবুও আইলার তা-বে বিধ্বস্ত এই বাঁধ আমফানে ফের বিধ্বস্ত হওয়ার পর এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের দাবি এবার স্থায়ী আর টেকসই বাঁধ তৈরি করা হোক। বাস্তবায়ন করা হোক ২০০৯ সালে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আনিসুর রহিম, সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদসহ একটি দল এলাকা ঘুরে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে উপকূল এলাকায় স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন । ২০ মে আমফানের তা-বে ভেঙ্গে যায় শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ তীরের ঘোলা বেড়িবাঁধ। ভাঙ্গনের তীব্রতা বেশি থাকায় এই এলাকাটুকু কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এলাকাবাসী। ইউনিয়নে ৬টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভাঙলেও ৫টি পয়েন্ট স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। এই ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় প্রায় ২০টি গ্রাম। ২৭ রমজান থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ স্বেচ্ছাশ্রমে এই বাঁধ এলাকায় রিংবাঁধ দেয়ার চেষ্টা করে। এ জন্য জেলা প্রশাসন থেকে দেয়া হয় ৩৯ টন চাল আর ৫০ হাজার টাকা। কিছু বাঁশ ও জিওব্যাগ দেয়া হয় পানি উন্নয়ন বিভাগ থেকে। কিন্তু পূর্ণিমায় পানির চাপে এই রিংবাঁধ ভেসে যায়। পুনরায় শুরু হয় এলাকাবাসীর বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম। ইউনিয়নের লোকজন ছাড়াও বাইরের ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী পুরুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে থাকে এই রিংবাঁধ তৈরির জন্য। এ জন্য পুনরায় জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৫০ টন চাল। টানা ৩৫ দিনের জীবন সংগ্রামে অবশেষে শনিবার প্রায় ১ কেলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা রিংবাঁধের কাজ শেষ করতে পেরেছে এলাকাবাসী। ইউপি চেয়ারম্যান এসএম আব্দুর রউফ জানান, আর এ জন্য মাত্র ব্যয় হয়েছে ৫০ টন সরকারী চাল। বাকি সব এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রম। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের শ্যামনগরের নোয়াবেকি হয়ে এই জনপদে যেতে হয় ট্রলারে করে। ঘণ্টাজুড়ে ট্রলার যাত্রার পর শুক্রবার দুপুরে এই জনপদে যেয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রচ- রোদের মধ্যে হাজার হাজার নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সীরা দ্রুত মাটি ভরাট করছেন রিংবাঁধের কাজ শেষ নামানোর জন্য। মাইকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য। জোয়ারের পানি এলে আবার ভেসে যাবে রিংবাঁধ। ব্যর্থ হয়ে যাবে টানা ৩৫ দিনের স্বেচ্ছাশ্রমের ফসল এমন আকুতি দিয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করা হয়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-১-এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান শনিবার বিকালে জনকণ্ঠকে বলেন, ঘোলার বাঁধভাঙ্গা এই এলাকার পরিমাণ প্রায় ৮০ মিটার। মন্ত্রণালয় থেকে এই এলাকায় ৬শ’ ৯৬ মিটার রিংবাঁধ তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। মূল বাঁধের ৩০ মিটার ভিতরে এই রিংবাঁধ তৈরি করা হবে। এলাকাবাসী রিংবাঁধ নির্মাণ করেছে মূল বাঁধের প্রায় ১ কিলোমিটার ভিতরে। ইউপি চেয়ারম্যান জানান, তাদের তৈরি রিংবাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ কিলোমিটার। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রামবাসীর তৈরি করা রিংবাঁধের দৈর্ঘ্য ৮শ’ মিটার। স্বেচ্ছাশ্রমে এই বাঁধ নির্মাণ করতে এলাকার সচ্ছল ব্যক্তিরা দিয়েছেন বাঁশ আর বস্তা। আর সাধারণ মানুষ দিয়েছেন কায়িক শ্রম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাও এই বাঁধ নির্মাণে অংশ নিয়েছেন। তবে ষাটের দশকে নির্মিত এই বেড়িবাঁধের স্থায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির বন্ডিং ক্ষমতা কমে গেছে। আর এ জন্য দাবি উঠেছে স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের।
×