ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অলিগলিতে মানুষের ভিড়, অনেকের মুখেই নেই মাস্ক ॥ পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা

করোনার পরোয়া নেই, মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২৮ জুন ২০২০

করোনার পরোয়া নেই, মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব

ওয়াজেদ হীরা ॥ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও শুরুর দিকের সেই সতর্কতা এবং আতঙ্ক এখন আর নেই। মানা হচ্ছে না সরকারী কোন নির্দেশনা। বাজারঘাট থেকে অফিসপাড়া কোথাও যেন নেই সামাজিক দূরত্ব। এমনকি অনেকেই এখন মাস্কও ব্যবহার করেন না। দেশে করোনা শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের পাশাপাশি সচেতনতাও ছিল তুঙ্গে। কেউ ভুলেও বের হতো না ঘর থেকে। অথচ সে সময় আক্রান্ত ছিল হাতে গোনামাত্র। শুরুর সময়ের চেয়ে এখন ভয়াবহ হলেও মানুষের মধ্যে সেই উপলব্ধি নেই। সরকারী নির্দেশনা না মানা এবং মানুষের এমন অসচেতনতার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সারা বিশ্ব কাঁপানো করোনা ভাইরাসটি দেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর দশদিন পর ১৮ মার্চ আসে করোনায় প্রথম মৃত্যুর খবর। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেই সঙ্গে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে সে সময় সচেতনতার দিক থেকে হোক আর করোনা রোগ থেকে বাঁচার ভয়ে হোক সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছে। ঘর থেকে যাতে বের হতে না হয় সেজন্য কেউ কেউ একমাসের বেশি নিত্যপণ্য একসঙ্গে ক্রয় করেছেন। নিজেদের নিরাপদ রাখতে সবাই ঘরবন্দী হয়ে যান। কেউ ঘর থেকে বাইরে বের হলেও মাস্কের পাশাপাশি হ্যান্ডগ্লাবসসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী পরে বের হতেও দেখা গেছে। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে মার্চ এপ্রিলের ওই সময়টায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। অল্পঅল্প করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। সবাই খোঁজ রাখতেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনও। হঠাৎ ৪-৫ জন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সবার চোখে মুখে কি অজানা আতঙ্ক, ভয় আর দুশ্চিন্তা দেখা যেত। অথচ ঈদের আগে থেকে ক্রমেই সেই সচেতনতার মাত্রা যেন ভেঙ্গে পড়েছে। ঈদের পর সেটি আরও বেশি দৃশ্যমান। সরকার জীবন ও জীবিকার জন্য সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে সতর্ক থেকে কাজকর্ম ও চলাফেরার পরামর্শ দিলেও সেটি মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। ডাঃ ফরিদ উজ জামান বলেন, আসলে শুরুর দিকে আমরা যেমন সতর্ক ছিলাম সেটি দিন দিন কেন যেন কমে গেছে। এতে সংক্রমণের মাত্রাটা আরও বাড়ছে। চলাফেরায় অসচেতনতার কারণে একজন রোগী থেকে অসংখ্য রোগী তৈরি হচ্ছে। সংক্রমণের মাত্রার হিসেবে আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যাও এখন অনেক বেড়েছে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সংক্রমণের ভিত্তিতে এলাকা ভাগ করে অধিক সংক্রমিত অঞ্চলে সরকারী-বেসরকারী সব অফিস আবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এতে সাধারণ মানুষ যদি সচেতনতার পরিচয় না দেন তাহলে সরকারের একার পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মাস্ক পরতে এখনও অনেকের আপত্তি দেখা গেছে। নানা যুক্তি দিয়ে মাস্ক না পরার কারণ ব্যাখা করতেও দেখা গেছে। যদিও সরকারী নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে মাস্ক ব্যবহারের কথা বলা রয়েছে। সেই সঙ্গে মাস্ক না পরলে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক না পরার কারণে জরিমানাও গুনতে হয়েছে অনেককে। তারপরও টনক নড়েনি অসচেতন মানুষের। পল্টনের এক ফল বিক্রেতা বলেন, অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। মুখে মাস্ক থাকলে অনেকেই কথা ভাল করে শোনে না। এদিকে, মাস্ক পরিধান করা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বড় হাতিয়ার বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাসিমা সুলতানা। অধ্যাপক ডাঃ নাসিমা সুলতানা বলেন, অজ্ঞান, প্রতিবন্ধী ও দুই বছরের নিচে শিশু, এ তিন শ্রেণীর মানুষ বাদে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। মনে রাখতে হবে মাস্কই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার। কিন্তু খোদ রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে মানুষের অসচেতনতার বিষয়টি। বাজারঘাট থেকে ছোট বড় সড়কের অলিগলি সর্বত্রই মানুষ আর মানুষ। কারো কোন প্রয়োজন না থাকলেও রাস্তায় ঘুরছেন। সম্প্রতি হাতিরঝিলে একটি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েক জন যুবককে গল্প করতে দেখে জানতে চাইলে শাহিনুর নামে একজন পরিচয় দিয়ে বলেন, বাসায় অনেক গরম আর এখানে প্রচুর বাতাস। এছাড়াও বন্ধুদের সঙ্গে গল্পও হয় না অনেক দিন তাই একটু গল্প করছি। করোনাভাইরাসের সচেতনতা নিয়ে তৈমুর নামের একজন বলেন, আমাদের এখানেই বাসা মধুবাগ। বাজারে গেলে আমরা মাস্ক পরি আর এখানে আমরা সবাই পরিচিত কারো করোনা হয়নি তাই আসলে পরা হয়নি! রাজধানীর বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানেও দেখা গেছে এমন অসচেতনতার দৃশ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারগুলোতে নিয়মিতই দেখা যায় মানুষের হাট! সামাজিক সুরক্ষা কিংবা দূরত্বের বালাই না থাকলেও যুক্তিতর্ক অদ্ভুত তাদের। কাওরান বাজারে কমপক্ষে দশ জন ক্রেতা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তাদের অভিমত, দেশে এখন যার হওয়ার এমনিতেই হবে। এত নিয়ম মেনে চলা তাদের জন্য কঠিন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আসিফ হোসেন ফল কেনার সময় বলেন, আসলে আমাদের নিজেদের জীবনের জন্যই নিয়ম মানা উচিত কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। নানা জায়গায় যেতে হচ্ছে আমি মানলেও আশপাশের মানুষের জন্য আমি সমস্যাগ্রস্ত হচ্ছি। সবজি বিক্রেতা তাহের মিয়া বলেন, ‘এই বিষয়ে আগে অনেক ডরাইতাম, দোকানও বন্ধ ছিল। এখন আর ডরাই না। যা হবার হবে, আল্লাই ভরসা।’ তবে এখনও তিনি মাঝে মধ্যে মাস্ক পরেন সেটিও জানালেন। প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর এই ঢাকায় ঈদের পর থেকেই বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে বাড়ি যাওয়ার যে স্রোত ছিল মানুষের। তাদের অনেকেই কর্মের কারণে ফিরেছে শহরে। মূল সড়কগুলোতে যানবাহনের নিয়মিত যানজট লেগে থাকছে। গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হলেও কোথাও কোথাও ধাক্কা ধাক্কি করে বাসে ওঠা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা শুরুর দিকে দেখলাম সবার মধ্যে একটা সচেতনতার বিষয়। হতে পারে নতুন রোগ নিয়ে ভয়ের কারণে। তবুও সবাই খুব সতর্ক, কেউ বেরই হতে চাইতো না। অথচ সে সময় আক্রান্ত ছিল এক শ’ থেকে হাজারের মধ্যে। অথচ এখন প্রতিদিন কয়েক হাজার আক্রান্ত অথচ মানুষের এই রোগ কিংবা নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে কোন চিন্তা নেই। কেউ কেউ অহেতুক ঘুরছে আবার অনেকেই ন্যূনতম মাস্ক ব্যবহার করেন না। এতে করে আমাদের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। একজন রোগী আরও অসংখ্য রোগী বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর হাতিরপুলের বাসিন্দা জমির উদ্দিন নিত্যপণ্য কিনতে এসে বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে একবার বের হই আর অবাক হই এই ভেবে যে আমি বা আমার পরিবারই মনে হয় ঘরবন্দী। বাইরে এরকম কোন লক্ষণ দেখি না। হেঁটে আসি তাও মানুষ গায়ের ওপর এসে পড়তে চায়। এ জন্য কখনও বাসার নিচে এসে সবজির ভ্যানের অপেক্ষায় থাকি যাতে বাইরের বাজারে না যেতে হয়।
×