ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির হাল!

প্রকাশিত: ২২:০৬, ২৮ জুন ২০২০

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির হাল!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রয়োজনে ৩১ মে থেকে গণপরিবহন চালু হয়। তবে এক জুন থেকে রাস্তায় নেমেছে বাস। নানা রকম স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত জুড়ে দিয়ে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেয় সরকার। এরপর কেটেছে প্রায় এক মাস। কেমন চলছে গণপরিবহন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ যানবাহনেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তবে এক আসনে যাত্রী একজন নেয়া হলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানিগুলোকে। একটা বিষয় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয়, তা হলো শর্ত পালনে বিআরটিএর পক্ষ থেকে তদারকি যেমন কমেছে তেমনি মালিক-শ্রমিকদেরও গা ছাড়া ভাব। তেমনি যাত্রীরাও খুব একটা সচেতন নন। লেগুনা ও অটোরিক্সায় স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা আরও বেশি। সব মিলিয়ে গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি পালনে একেবারেই ঢিলেঢালা পরিস্থিতি। পরিবহন মালিক শ্রমিকরা বলছেন, সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচল করলেও যাত্রী সঙ্কট চরমে। বেশিরভাগ বাসে আসন পূর্ণ হয় না। ফলে পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ কঠিন হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে স্বেচ্ছায় গাড়ি চালানো বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবেনা বলছেন মালিক সমিতির নেতারা। শ্রমিকরা বলছেন, আগের মতোই চুক্তিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। কিন্তু যাত্রী কম। যাত্রী না হওয়ায় মালিকের আমদানির টাকাই তোলা কষ্টকর হয়। এমন দিন যায় একশ টাকাও জনপ্রতি থাকে না। তাহলে সংসার চলবে কিভাবে? দৈনন্দিন কাজের প্রয়োজনে দুর্যোগপূর্ণ এ পরিস্থিতিতেই সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করতে হচ্ছে বাস-লেগুনাসহ বিভিন্ন যানবাহন। তবে গণপরিবহনের কোথাও যাত্রী সঙ্কট আবার কোথাও উপচেপড়া ভিড়ের সৃষ্টি হচ্ছে। বাস মালিকদের নেয়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর অনেক যাত্রীরই আস্থা তৈরি হচ্ছে না। ফলে যাত্রীদের একাংশ বাসে উঠছেন না। আবার অনেক জায়গায় বাধ্য হয়ে ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে দেখা গেছে যাত্রীদের। যাত্রীদের অভিযোগ, করোনাকালের জন্য সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া আদায় করছে বাসগুলো। স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন না বাস শ্রমিকরা। পরিবহন মালিকরা বলছেন, রাজধানীতে সব মিলিয়ে ৬০ ভাগ বাস চলাচল করছে। প্রায় একমাসের প্রতিদিনই চালকরা যাত্রী সঙ্কটের অভিযোগ করে আমদানি টাকা কমানোর চাপ দিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, গণপরিবহন থেকে বেশি ছড়াতে পারে ছোঁয়াচে রোগ। সাম্প্রতিক সময়ে যে ক’বার ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে সেই গবষেণা থেকেই এ তথ্য মিলেছে। তাই গণপরিবহন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আট মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি গণপরিবহন লকডাউন করার ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। দেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় চলা সাধারণ ছুটি ৩১ মে থেকে তুলে নেয় সরকার। এদিন থেকে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা আসে। শনিবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব বাসের আসনে একজন করে যাত্রী আছে। তবে বেশিরভাগ বাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়া হচ্ছে না। বাসও জীবাণুমুক্ত করা হয় না। তাপমাত্রা মাপার কোন ব্যবস্থা নেই একটি গাড়িতেও। গেটে কন্ডাক্টর দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে ধরে যাত্রী তোলেন দিব্যি। কখনও বাস থেকে নেমে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। কোন বাসেই নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। অনেক বাস চালক ও হেলপারকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। কোন কোন বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। মনের সুখে চালককে সিগারেট খেতেও দেখা যায়। ভাড়া নিয়ে তো বচসা আছেই। লেগুনায় কোন রকম স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। যত আসন ততো যাত্রী তুলে আনা নেয়া করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কোন রকম ব্যবস্থা নেই। একই চিত্র প্রায় অটোরিক্সার ক্ষেত্রেও। তবে অনেক বাসে আসন ফাঁকা দেখা গেছে। কোন কোন বাসে দুই থেকে পাঁচজন যাত্রীও দেখা যায়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন শ্রমিকরা ডাকাডাকি করলেও আশানুরূপ যাত্রী গাড়িতে উঠছেন না। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক মানুষ গণপরিবহন এড়িয়ে চলছেন। অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন, এমনকি এটাকেই অভ্যাসে পরিণত করছেন। কেউ কেউ বাইসাইকেল নিয়ে চলাফেরা করা শুরু করেছেন। আন্তঃজেলা রুটে বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। ঢাকা থেকে নেত্রকোনাগামী শাহজালাল পরিবহনে আগের ভাড়া ছিল ২৫০ টাকা। ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করায় সর্বোচ্চ ভাড়া ৩৫০ টাকার বেশি হয়না। কিন্তু সকল যাত্রীর কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৫৪০ টাকা করে। অর্থাৎ যাত্রী প্রতি ১০০ টাকা ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কাউন্টারের লোকজন এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তারা জানিয়েছেন, মালিকের নির্দেশ পালন করছেন। লাভলী পরিবহনের হেলপার সুমন জানালেন, ৪৫ আসনের গাড়িতে এখন যাত্রী আছে সাত জন। আমরা কিভাবে চলি, মালিককে আমদানি কিভাবে দেই। প্রথম প্রথম মালিক স্যাভলন পানি দিত যাত্রীদের দেয়ার জন্য, এখন আর দেয় না। নিউ ভিশন পরিবহনের ড্রাইভার সোলেমান জানালেন, আমরা নিয়ম মেনে ভাড়া নেই। কারও থেকে বেশি নেই না। অথচ যাত্রীরা বেশি নেয়ার অভিযোগ করেছেন। তিনি জানান, সকালে কিছু যাত্রী হয়। এরপর সারাদিন যাত্রী নেই। বিকেল থেকে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। এভাবে বেশিদিন গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না। যাত্রী সঙ্কটের বিষয়ে সিটিং সার্ভিস পরিবহনের হেলপার বাপ্পি বলেন, যাত্রী কম। মানুষ এখন আর বাসে উঠতে চায় না। সিট ফাঁকাই থাকে। তাই মালিকরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। করোনার কারণে যাত্রীরা এখন রিক্সা, সিএনজিসহ ছোট পরিবহনে বেশি যাতায়াত করছেন। স্বাভাবিক সময়ে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত বাসের নির্ধারিত ভাড়া ছিল ১৭ টাকা। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই নিয়ম না মেনে এই ভাড়া নেয়া হতো ২৫ টাকা। কিন্তু এখন যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। অথচ ১৭ টাকার সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ৬০ শতাংশ যুক্ত হলে ভাড়া দাঁড়ায় ২৭ টাকা ২০ পয়সা। বাসাবো থেকে মগবাজার ১০টাকা ভাড়া ছিল আগে। এখন লাব্বাইক পরিবহনে নেয়া হচ্ছে ২০টাকা। সায়েদাবাদ থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২৪ টাকা। এর সঙ্গে ৬০ শতাংশ যুক্ত হলে ভাড়া দাঁড়ায় ৩৮ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ৬০ টাকা। জানতে চাইলে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের চালক ইব্রাহিম বলেন, সরকারী ভাড়া কত সেটা তো জানি না। তবে আমাদের মালিক মিরপুর থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ৪৫ টাকা নিতে বলেছেন, সেজন্য নিচ্ছি। এর বেশি বলতে পারব না। বলাকা, গাজীপুর ও তুরাগ, প্রভাতি বনশ্রী পরিবহনের কিছু বাসে আসন একজন করে ফাঁকা থাকলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। দাঁড়ানো যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগের মুখে মাস্ক নেই। কারণ জানতে চাইলে তুরাগ পরিবহনের হেলপার সোলেমান বলেন, যাত্রীরা জোর করে বাসে উঠে যায়। তাদের আটকানো যায় না। তবে সুরক্ষা সামগ্রী না থাকার কোন জবাব দিতে পারেননি তিনি।
×