ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্পর্শকাতর শিল্পীমন, ছবি এঁকে শান্ত করার চেষ্টা

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২৮ জুন ২০২০

স্পর্শকাতর শিল্পীমন, ছবি এঁকে শান্ত করার চেষ্টা

মোরসালিন মিজান ॥ অদ্ভুত অচেনা একটি সময়। এমন সময়ের কথা কেউ কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। দিনের পর দিন ঘরবন্দী মানুষ। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোন সংযোগ নেই। সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা, একলা জীবন ছবি আঁকার জন্য কি অনুকূল? নাকি স্পর্শকাতর শিল্পীমন বিষাদে ডুবেছে। তাদের ক্যানভাসের রং কেমন এখন? কতটা রঙিন? নাকি বিবর্ণ? প্রশ্ন যেমন অনেক, উত্তরও সবার এক নয়। তবে একটি বিষয় বোঝতে অসুবিধে হয় না যে, বর্তমান বৈরী পরিস্থিতি শিল্পীমনে মারাত্মক ক্রিয়া করছে। সেই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ছবি হয়ে ক্যানভাসেই ভেসে উঠছে। অনেকে বিমূর্ত ছবি আঁকছেন। স্মৃতি থেকে তুলে আনছেন জীবনের জলছবি। তবে প্রিয় ক্যানভাসকে সবাই আশ্রয় করতে পারছেন এমন নয়। বিশেষ করে সিনিয়র শিল্পীদের একটি বড় অংশ মানুষ প্রকৃতি পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণে ছবি আঁকতে পারছেন না। হাতে অফুরন্ত সময়। এর পরও মনকে জাগানো কঠিন কর্ম হয়ে গেছে। হতাশা আতঙ্ক ঘিরে রেখেছে তাদের। অর্থাৎ শিল্পীরা একেকজন একেক রকম বাস্তবতার মুখোমুখি। যারা ছবি আঁকছেন তাদের কথাই আগে বলা যাক। করোনার কালে বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুল হক, মোহাম্মদ ইউনুসসহ অনেকেই ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। আরও জুনিয়র যারা, ছবি আঁকছেন তারাও। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করছেন শিল্পীরা। এমনকি অনলাইনে প্রদর্শনীও চোখে পড়ছে। জানা যায়, তিন মাস ধরে ঘরে আছেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম। ধানমন্ডির বাসা থেকে একদমই বের হচ্ছেন না। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে দিন, পুরোটা সময় ঘরে। কথা প্রসঙ্গে শিল্পী বলছিলেন, আমি চল্লিশ দিনের বেশি দিন দরজাই খুলিনি। কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। কথা বলে বোঝা গেল, বাইরে বের হতে না পারায় শিল্পীর বিশেষ মন্দ লাগা নেই। এ নিয়ে ভাবেনও না। তবে যে কারণে বের হওয়া যাচ্ছে না সে কারণটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। শিল্পী বলেন, আমাদের তো বয়স হয়েছে। বিপদের আশঙ্কাও বেশি। প্রথম এক মাস ছবি আঁকতে পারিনি। এখন নিয়মিত ছবি আঁকছি। শরীর সুস্থ। বয়স হলেও, লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে পারছি। জানা যায়, বর্তমানে বিভিন্ন সিনেম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা, সাময়িকী, বই ইত্যাদির পাতায় ছবি আঁকছেন শিল্পী। ১০ হাজার পাতা ভর্তি করে ছবি আঁকতে চান। সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন। সাম্প্রতিককালের ছবি দেখে বোঝা যায়, মনিরুল ইসলাম বরাবরের মতোই বিমূর্ত। অবশ্য মূর্ত বিমূর্ত কিছু স্বীকার করেন না তিনি। বলেন, আমি গোলাপ নয়, গোলাপের ঘ্রাণটাকে আঁকার চেষ্টা করি। ছবিতে করোনার প্রভাব কতটা পড়ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা সেভাবে কোথাও নেই। আঁকা ছবি আমাকে সারপ্রাইজ না করলে আমার বোরিং লাগে। নিজেকে সারপ্রাইজ করতে পারে এমন ছবি আঁকছেন বলে জানান তিনি। প্রচুর ছবি আঁকছেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হকও। শুধু আঁকছেন বললে ভুল হবে। বর্তমানে তার ছবির একটি থ্রিডি ভার্চুয়াল প্রদর্শনী চলছে। ‘বৈশ্বিক দুর্যোগের গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে এ্যাক্রেলিক মাধ্যমের ৩৫টি ছবি স্থান পেয়েছে। ঘরবন্দী জীবনে স্বাধীনতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন শিল্পী। জানা যায়, করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই ঘরে রয়েছেন মোস্তাফিজুল হক। অবশ্য স্টুডিওতে রয়েছে বললেও ভুল বলা হবে না। কাকরাইলের নিজের ফ্ল্যাটের একটিতে শিল্পী বসবাস করেন। অন্যটি স্টুডিও। খাওয়ার সময় ছাড়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্টুডিওতেই অবস্থান করছেন তিনি। তার মানে সময়টা ছবি আঁকার পক্ষে আছে? এমন প্রশ্নে শিল্পী বলেন, আমি ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। বাইরের সব ব্যস্ততা দূর হয়ে গেছে। তাই স্টুডিওতে বসে ছবি এঁকে যাচ্ছি। বাসার উপরে নয় তলায় আমার স্টুডিও। সেখানে সারাদিন কাটাই। বাসায় শুধু রেস্ট নিতে আসি। তিনি বলেন, আমি ডিপ্রেশনে চলে যেতে চাই না। ছবি আঁকা আমাকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগাচ্ছে। করোনাকালে আঁকা ছবিতে তার কী বলা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোরগ, শকুন ইত্যাদিকে প্রতীকী উপস্থাপনা দিয়েছি আমি। এসবের মধ্য দিয়ে করোনা কালের জীবন ও এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশার কথা বলেছি আমি। শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুসেরও নিজস্ব স্টুডিও। উত্তরায় বাসা। বাসার ঠিক উপরে স্টুডিও। সেখানে ছবি এঁকে চলেছেন তিনি। কী ওঠে আসছে আপনার ছবিতে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যরকম একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে হতাশার এই সময়কে আমি ক্যানভাসে আর ধরে রাখতে চাইছি না। আঁকায় কোন চেঞ্জ আনছি না। আশা ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্রাইট ছবি আঁকছেন বলে জানান তিনি। শিল্পী প্রদ্যোত কুমার দাস সরকারী চাকরি করেন। শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের ইনস্ট্রাক্টর। এখন বাসায় বসে ছবি আর ছবি আঁকছেন শুধু। একটা নতুন মিডিয়া নিয়ে অনেক দিন ধরে নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। এবার রং তুলি হাতে ছবি আঁকছেন। প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে ছবি পোস্ট করছেন তিনি। কথা বলে মনে হলো, ছবি আঁকা বেশ স্বস্তি দিচ্ছে তাকে। শিল্পী বললেন, আমি সরকারী চাকরি করি। প্রচুর কাজ। নিজে যে শিল্পী, সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। মনে ক্ষুধা ছিল। কিন্তু ছবি আঁকার সময় পাচ্ছিলাম না। কিন্তু সাধারণ ছুটির পর থেকে বাসায়। এখনও বেশিরভাগ সময় বাসায় থেকেই অফিস করছি। ফলে হাতে অনেক সময়। প্রতিদিনই ছবি আঁকছি। একটা অন্যরকম সময়। এত কিছু দেখছি। কিছুও যদি ছবি করে রাখতে পারি ভাল লাগবে। তাই এত ছবি আঁকা বলে জানান তিনি। তবে আগেই বলা হয়েছে, ছবি আঁকার মতো মানসিক অবস্থা নেই অনেক শিল্পীর। এ তালিকায় বেশি আছেন সিনিয়র ও বিখ্যাতরা। এত এত মানুষের মৃত্যু তাদের কষ্ট দিচ্ছে। শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছবি আঁকার কথা চিন্তা করতে পারছেন না তারা। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বরেন্য শিল্পী হাশেম খানকে ফোন করা হলে অপর প্রান্ত থেকে অচেনা অসম্ভব শীতল একটি কণ্ঠ ভেসে আসে। কোন সৌজন্য দেখানোর মিথ্যা চেষ্টা না করেই বলেন, আমি ভাল নেই। তিনি জানান, করোনার মধ্যেই তার স্ত্রী দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছেন। পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখন চিকিৎসা দুর্লভ। তাই প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। বর্তমানে ভাঙ্গা পা নিয়ে বাসায় কাতরাচ্ছেন বৃদ্ধা স্ত্রী। সে কষ্ট নিজের চোখে শিল্পীকে দেখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ছবি আঁকার কথা ভাবাই যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি। মানসিক চাপ অনুভব করছেন আরেক সিনিয়র শিল্পী রফিকুন নবীও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত ১৯ মার্চ থেকে ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছি। কারও সঙ্গে দেখা নেই। কথা নেই। চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি কিছুই দেখি না। তার উপর প্রতিদিনই খারাপ খবর আসছে। এত লোক মারা যাচ্ছে, কষ্ট লাগে। ওই মন নেই যে, ছবি আঁকবো। এখনও বাসার সবাই সুস্থ আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সময় ভাল হলে, মনটা শান্ত হলে ছবি আঁকবো।
×