ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

আইন মানতে হবে সবাইকে

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২৮ জুন ২০২০

আইন মানতে হবে সবাইকে

একজন মানুষের আত্মমর্যাদা জেগে ওঠে শিশুকাল থেকে। একজন শিশুকে তার আত্মমর্যাদা জাগ্রত করতে মা-বাবার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু যদি জন্মের পর তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে শিখে তখন যদি দেখে মা-বাবা সব সময় ঝগড়া করে, সেই পরিবেশে সে যদি বড় হয়, তা হলে তার মধ্যে অল্প বয়সে হীনম্মন্যতা জেগে উঠবে। সে যদি মা-বাবার স্নেহ ও আদর যত্ন ও ভালবাসার পরিবেশে বড় হয়, তাকে যদি সব সময় প্রশংসা করা হয়, তার চাহিদা মতো এবং পছন্দ মতো খেলার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়, সে যদি বুঝতে পারে তার প্রতি সকলেই আন্তরিক এবং তার কথা পরিবারের সকল সদস্য গুরুত্ব দেয়, তখন তার মধ্যে আত্মমর্যাদা জেগে ওঠে, তখন সে অন্যকে সম্মান দিতে শিখে। কেউ ধমক দিলে সে খুব মন খারাপ করে এবং ধমককারীকে পরবর্তীতে এড়িয়ে চলে। আমার জন্ম বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে আমি বড় হয়েছি সেই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা করেছি। গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে অনাদরে, অবহেলা, অপরিষ্কার পরিবেশ, নানা প্রতিকূলার মধ্য দিয়ে বড় হয়। না পায় কোন আদর যত্ন, না পায় কোন উপদেশ ও সঠিক গাইড। এর মধ্যে তার আত্মমর্যাদা জেগে ওঠার মতো কোন অনুভূতি জাগ্রত হয় না। যার জন্য গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হলে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে, নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, কোন উদ্যোগ নিতেও ভয় পায়। সব সময় হীনম্মন্যতায় ভোগে। প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলে। আর যারা পরবর্তীতে গ্রামের গন্ডি পেড়িয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে যান, তখন তারা নানা মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন। তবে ধীরে ধীরে মনের হীনম্মন্যতা দূর করতে অনেকেই সক্ষম হন। অনেকে সেই গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই আমাদের আত্মমর্যাদা সম্পন্ন হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, নিজেকে সম্মান করতে হবে এবং অন্যকে-সম্মান দিতে হবে। এই ব্যাপারে মাও বাবার শিশুর ছোটকাল থেকে তার মধ্যে যাতে আত্মমর্যাদা জাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের জন্য সারা বিশ্বের মানুষ যখন সেই দেশের সরকারী আদেশ মেনে নিজের ঘরে অবস্থান করছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ ঘরে থাকার জন্য সরকারী আদেশ না মেনে অবাধে সব জায়গায় বিচরণ করছেন, সামাজিক দূরত্ব যখন আইনে পরিণত হয়েছে, তখন সামাজিক বিবাহ হচ্ছে অনেক স্থানে। তার অর্থ এই দাঁড়ায় সরকারের কথা এবং পৃথিবীর মানুষের অবস্থা জেনেও বাংলাদেশের মানুষ কেন সামাজিক দূরত্ব নিজে থেকে পালন করা শুরু করেনি। এই সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ ঘরে থাকার জন্য সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। পৃথিবীর কোন দেশে সামাজিক দূরত্বে ত্থাকা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী দিয়ে ভয় দেখিয়ে লাটিপেটা করে মানুষকে ঘরে নিতে হয়েছে বলে জানা নেই। দেখেছি পুলিশ কর্তৃক পিটিয়ে জোরপূর্বক মানুষজনকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের আত্মমর্যাদা এবং মেধা খুব কম। তাই কোন কিছু বুঝতে অনেক দেরি হয় এবং শারীরিক লাঞ্ছনার স্বীকার না হলে কারও কোন উপদেশ শুনতেও আমরা রাজি হই না। এটা আমাদের জাতিগত দৈন্যতা ও ব্যক্তিত্বের অভাব। তা না হলে কেন আপনাকে পুলিশ লাটি দিয়ে পেটাবে? কোন সভ্য দেশে পুলিশ তো কোন চোর ডাকাতকে ধরলেও লাটি দিয়ে পিটায় না, ভদ্র ও মানবিক আচরণ করে। আপনাদের যদি নিজের আত্মমর্যাদা থাকত, তাহলে সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে আপনারা ঘরের বাইরে যেতেন না এবং পুলিশও আপনাকে লাঠিপেটা করার সাহস করত না। একটি ছোট ঘটনার কথা উল্লেখ করছি, ২০০৭ সালের সকাল ৯ ঘটিকার সময় হেঁটে ঢাকার মৌচাক মার্কেট থেকে নিউ ইস্কাটন দিলু রোডে যাচ্ছিলাম। মগবাজার ঘুরে লাল বাতির সিগন্যাল পরায় ফুট। পাতে দাঁড়িয়ে সবুজ বাতির অপেক্ষা করছিলাম। আমার সামনেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়ানো। হঠাৎ একজন রিক্সা।অয়ালা আমাদের দুই জনের কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখনও সবুজ বাতি জ্বলেনি। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তা রিক্সাওয়ালাকে এমনভাবে তার কাঁধে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা দাঁড়িয়ে রইলো। আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। পুলিশ কর্মকর্তাকে বললাম তাকে না মেরে মুখে আইন ভঙ্গ না করার জন্য বলতেন বা নিয়ম অনুযায়ী ফাইন করতেন! পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বললেন, আগামীকাল সে যখন এই রাস্তা দিয়ে যাবে তখন তার এই আঘাতের কথা মনে পড়বে আর আইন ভঙ্গ করবে না। যদি তাকে না মারা হতো সে আবারও আইন ভাঙত। তার কারণ আমাদের মধ্যে আত্মচেতনা এখনও জাগ্রত হয়নি সর্ব ক্ষেত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সরকারী ত্রাণের চাল জনপ্রতিনিধিগণ আত্মসাত করার জন্য ৫০ জনের অধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কি হতে পারে। কেন গ্রামের চেয়ারম্যানগণ এই রকম অসৎ পথে পা বাড়ায় বুঝে উঠতে পারি না। দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার হবে। কেন মানুষ এত অমানবিক হয়ে ওঠে তার গবেষণা করা দরকার। জাতিসংঘের প্রধান, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নির্বাহী প্রধান বলেছেন, এশিয়ার দেশগুলি করোনা পরবর্তীতে দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে পারে। তাই তাদের তা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে হবে। একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সামাজিক নিরাপত্তা। তাই তাদের আরও মানবিক ও জনগণের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে কাজ করতে হবে। কারণ এই জনগণ হচ্ছে একটি দেশের প্রথম এবং প্রধান ক্ষমতার নিয়ামক। সুতরাং তাদের হেয় এবং অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। আইন রক্ষাকারী বাহিনীর আইনকে সংস্কার করা খুব দরকার। কারণ পৃথিবীর মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবী অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এ পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। মানুষ আজ ঘরে বসে পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। পৃথিবী আগের মতো আর অনেক দূরে নয়। পৃথিবী এখন অনেক ছোট হয়ে আসছে। তাই যে সমাজ এই পরিবর্তনকে যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারবে, সেই সমাজ উন্নয়নে এগিয়ে যাবে। করোনা মহামারী অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষ যে আমরা একই সূত্রে গাঁথা, তা করোনায় আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। করোনা তো বড় দেশ শক্তিশালী দেশ, গরিব দেশ ইত্যাদি বিবেচনা করে মানুষকে আক্রান্ত করেনি। যাকে সামনে পাওয়া গেছে তাকেই আক্রান্ত করেছে। পরিশেষে পুলিশ ভাইদেরও বলতে চাই, আপনারা আমাদেও কারও ভাই, কারও বোন, কারও পিতামাতা। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করুন। দেশের মানুষের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংরক্ষণ চুক্তি মেনে একজন সন্দেহজনক ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত কোর্ট কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে আইনের সুরক্ষা দেয়া আপনার কর্তব্য। তাকে নিপীড়ন করা কোন অবস্থাতেই আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×