ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

বাজেট ॥ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও উন্নয়ন

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৮ জুন ২০২০

বাজেট ॥ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও উন্নয়ন

প্রায় শেষের পথে বাজেট অধিবেশন। এবার অধিবেশন হয়েছে সংক্ষিপ্ততম। সাংসদরাও একযোগে বসছেন না বা বসতে পারবেন না। এমন একটি অধিবেশনকে ‘জরুরী অবস্থা’ জারি করে অনেক দেশ সম্ভবত সংসদ অধিবেশন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত সার্টিফায়েড বাজেট ঘোষণা করবে। আমরা সে পথে যাইনি। তবে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা যদি সংসদে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হয়, বাজেট অধিবেশন কি তাতে অর্থবহ হয়? আমাদের বাজেট অধিবেশনগুলো তো এতকাল স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তাতেও জনমতের প্রতিফলন খুব কমই ঘটেছে। সাংসদরা জনমত-জনস্বার্থের চাইতে দলীয় স্বার্থ ও ওপরতলার দিকে লক্ষ্য রেখে মতামত প্রকাশ করেছেন। ফলে জনমত হয়েছে উপেক্ষিত। এবারে কি হবে? এবার করোনা কিন্তু সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অতীতের বাজেটগুলো বহুলাংশেই দেশের ব্যাপক মানুষের জরুরি প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে প্রণীত হয়নি। করোনার শিক্ষাকে যদি ঠিকমতো উপলব্ধি না করি, যদি তাকে ঠিকমতো কাজে না লাগাই তাহলে মারাত্মক ভুলই শুধু হবে না, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পরে। এক নম্বর শিক্ষা করোনা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেশোপযোগী, সময়োপযোগী ও জনগণের প্রয়োজন উপযোগী নয়। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রতি বছর অতি ক্ষুদ্র অঙ্ক, যা প্রয়োজনের এক চুর্তথাংশও না। তার ওপর ঘটেছে বাধাহীন সীমাহীন দুর্নীতি। ফলে জনসংখ্যা অনুপাতে হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ চাহিদা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়নি। ডাক্তার-নার্সের সংখ্যাও থেকেছে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যের অপরাপর কর্মীর সংখ্যাও তাই। বেড সংখ্যা এতই অল্প, যা চাহিদার ১০ ভাগও পূরণে অক্ষম। উন্নয়ন বলতে কি বুঝব? বড় বড় বহুতল বিশিষ্ট আকাশচুম্বি চোখ ধাঁধানা দালান কোঠা? কতগুলো রাস্তা, সেতু ও বিপণি-বিতান, দামী দামী গাড়ি? অন্তত সরকারের এতদিনকার উন্নয়ন মডেল দেখে তেমনটাই মনে হয়। অতীতে মানুষের চোখ এড়িয়ে গেলেও এবারকার (২০২০-২০২১এর) বাজেটের প্রতি তীক্ষè নজর থাকবে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। করোনার অভিজ্ঞতার আলোকে যে কোন জনবান্ধব সরকারের দায়িত্ব হলো বাজেটে এক নম্বর প্রাধান্য স্বাস্থ্য খাতকে দিয়ে ঐ খাতে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ করা এবং সে প্রয়োজনে ঐ দুটি শহরে অন্তত দুটি করে নতুন হাসপাতাল, নতুন মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সরকারী ওষুধ প্রস্তুত কারখানা স্থাপন, সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ডাক্তার-নার্সদের সুযোগ-সুবিধা বর্তমানের তুলনায় বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২৫,৭৩৩ কোটি টাকা। জানা যাচ্ছে আসন্ন বাজেটে তা নামমাত্র বাড়িয়ে ৩০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে। এই লোক দেখানো ৪,০০০ কোটি টাকা দিয়ে এই খাতে কি উন্নয়ন ঘটানো যাবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু আমরা তো জানি, আমাদের বাজেটে মোট বরাদ্দ থাকে লাখ লাখ কোটি টাকার। সে ক্ষেত্রে বাজেটের সিংহভাগ খতিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যাবে অপ্রদশিত খাতেই বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ। যদিও বিষয়টি সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। যেসব খাতে উচ্চব্যয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকটা অপ্রয়োজনীয়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোন দেশের শত্রুতা নেই যে তারা বাংলাদেশকে আক্রমণ করবে। অপরদিকে বাংলাদেশের নীতি হলো ‘কোন ক্রমেই বাংলাদেশ কাউকে প্রথম আক্রমণ করবে না।’ পাকিস্তান? তার কোমর একাত্তরে এমনভাবে ভেঙে দেয়া হয়েছে যে, আজও দেশটি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এহেন ঘৃণ্য, গণবিরোধী দেশটিকেও যখন স্বাস্থ্যখাতে আমাদের চাইতে উন্নত বলে খবর পাই-তখন স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সরকারী নজরের ঘাটতি ধরা পড়ে। কেরালা ভারতের একটি ছোট্ট প্রদেশ। তারাও তাদের উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কঠোরতা দিয়ে করোনাকে এমন সফলভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছে যে, তা বিশ্বের নজর কেড়েছে। তুলনামূলকভাবে কেরালার চাইতে আমাদের বাজেট অনেক বৃহদাকারের হওয়া সত্ত্বেও এমন দুর্দশা কেন? কিউবা-ভিয়েতনাম, গ্রীস, অষ্ট্রেলিয়ার কথা নাই বা তুললাম। বস্তুত তাদের অভাবনীয় সাফল্যের মূল কারণটি হলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ চলে যায় সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ভারত প্রভৃতি দেশে। কারণ প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য ঐ দেশগুলোতে যায়- সে করণে। কিন্তু ঐ বৈদেশিক মুদ্রাকে দেশেই রাখা সম্ভব হতো যদি আমরা স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন মতো করতাম। যদি আমরা আধুনিক, উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত, সহজলভ্য ও জনগণের আস্থাশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারতাম। যা হোক, অতীতের এই ভয়াবহ ত্রুটির এবার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রতি জেলায় একটি করে কমপক্ষে দুই হাজার বেডের সংবলিত উচ্চমানের হাসপাতাল, নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, সকল উপজেলায় ২৫০ বেড হাসপাতাল নির্মাণ ও সুসজ্জিতকরণ, আইসিইউ প্রয়োজনানুরূপ সংখ্যায় সকল জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে স্থাপন এবং এ ব্যাপারে আদৌ কালবিলম্ব যাতে কোন অজুহাতেই না ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এবং সকল নাগরিকের জন্য অবশ্যই বিনামূল্যে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো করতে পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুস্থ রাখতে পারব, রোগাক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারব এবং বিদেশে হাজারে হাজারে গিয়ে যে লাখ লাখ বিদেশী মুদ্রা সুচিকিৎসার জন্য বৈধভাবে পাচার হয়, তাও রোধ করতে পারব। শুধু তাই না, বাংলাদেশে অবস্থানকারী হাজার হাজার বিদেশীর চিকিৎসার মাধ্যমেও অনেক দেশী-বিদেশী মুদ্রা অর্জন করতে পারব, যদি আমরা উন্নতমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। স্বাস্থ্য বাজেট প্রণয়নে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করাও জরুরী। শিক্ষা শিক্ষা যে সর্বাধিক উন্নয়নের প্রধানতম মাধ্যম, তা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। দেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার না ঘটিয়ে বা জনগণকে অশিক্ষিত করে রেখে কোন দেশই পৃথিবীতে উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। আমাদের দেশে, উদাহরণস্বরূপ, উপযুক্ত প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ানের অভাবহেতু বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিতে হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। নিজ দেশে ঐ জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী মুদ্রার সাশ্রয় হতো। কিভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব উপযুক্ত প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান যারা ঐ দুটি প্রকল্প বা তার চেয়েও উন্নত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম? কিভাবে আমরা উপযুক্ত সংখ্যক হাসপাতাল নির্মাণ ও উচ্চমানের চিকিৎসক-নার্স প্রভৃতি গড়ে তুলতে পারি? সে ক্ষেত্রেও একমাত্র মাধ্যম বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের বেকারত্বও ঘোচানো সম্ভব। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করতে পারছেন, একমাত্র দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন বলে। আমরা বেকার-অশিক্ষিত যুবক যুবতীকে বিদেশে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার অভাব ও অদক্ষতার কারণে বিদেশে স্বল্প বেতনের চাকরি করতে এবং যখন তখন চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তার মাধ্যমে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধিও ঘটছে। কিন্তু আমরা যদি সকল জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারি, তাহলে যেমন তাদের অনেককে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারতাম, তেমনই আবার বিদেশে উন্নত চাকরির বাজারের দুয়ারও তাদের জন্য খুলে যেত। ফলে বিদেশ থেকে তারা দেশে অনেক অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে অনেক বেশি মজবুত করে গড়ে তুলতে পারবেন। দেশের অধিকতর উন্নয়নও তার ফলে সহজ হতে পারে। সকল দিক বিবেচনা করে ২০২০-২০২১ সালের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে চলমান অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের কম পক্ষে চারগুণ করে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখছি জাতীয় সংসদের কাছে। একই সঙ্গে সকল খাতের সকল কর্মকান্ড যাতে প্রকৃতই দুর্নীতিমুক্ত হয়, তার জন্য যাবতীয় কঠোরতা অবলম্বনেরও সুপারিশ করছি। লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত [email protected]
×