ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পৃথার সমাজ পাঠ

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ২৭ জুন ২০২০

পৃথার সমাজ পাঠ

-করছো কি করছো কি? ধরো না! ওসব বুয়া এসে নিয়ে যাবে! এগুলো ঝুটা খাবার। শিক্ষিকা নাসিমা ম্যামের কথায় কিছুটা আড়ষ্ট হলো পৃথা! শিক্ষক বলে কথা! সম্মান দেখাতেই হয়! অনেকটা ভৃত্যের মতো নরম ভঙ্গিমায় বিনয়ের সঙ্গে পৃথা বললো - না ম্যাম খাবারগুলো ঝুটা হয়নি! অন্য কেউ খেতে পারবে! খাবারের যে দাম! রান্নাঘর থেকে গরম করে আনি ম্যাম? -ঠিক আছে যাও। দেখো হাত টাত পুড়ে ফেলো না আবার! পৃথাকে সাহায্য করার জন্য আসিয়া বুয়াকে ডেকে বললেন ম্যাম। সহপাঠী তানহাকেও সঙ্গে নিলো পৃথা! রান্নাঘরে গিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেটের অবশিষ্ট খাবারগুলো গরম করতে লাগলো ওরা! - এই তানহা, বক্সে রাইসগুলো ভর তো? ওরে একটু হেলপ করেন না আসিয়া খালা? তেরোটি বক্সে সাজানো হলো। তারপর বাক্সগুলোর মুখ আটকিয়ে পৃথা ও তানহা তা নিয়ে এলো নাসিমা ম্যামের কাছে! বাইরে ক’জন ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে আছে! যাই ম্যাম, দিয়ে আসি? কোচিং সেন্টারে চারজন শিক্ষিকা! সবাই সিদ্ধেশ্বরীর নামকরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষয়িত্রী! গুলশান আখতার, আঞ্জুমান আরা, আয়েশা ফয়েজ ও নাসিমা বেগম! চারজনের নামের ইংরেজী আদ্যাক্ষর দিয়ে জ্ঞান (GAAN) কেন্দ্র। গুলশান ইংরেজী, আঞ্জুমান বাংলা, আয়েশা সমাজ এবং নাসিমা ম্যাম অঙ্ক পড়ান! তৃতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী শিক্ষার কোচিং সেন্টার এটি। জ্ঞান কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে! ১১ মাস জুড়েই এ অবস্থা! অভিভাবকরা এখানে পড়ান স্কুলে মেয়েদের বিশেষ সুবিধা পাবার জন্য। ম্যামরা ক্লাসে ছাত্রীদের বলেন জ্ঞান কেন্দ্রে কোচিং করলে স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে ভাল ফলাফল নিশ্চিত! পৃথা ও তানহা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। দু’জনের বাসা মৌচাকের কাছে। তানহা তৃতীয় শ্রেণী থেকে এখানে কোচিং করছে। তানহার মায়ের পীড়াপীড়িতে পৃথার আম্মা মেয়েকে জ্ঞান কেন্দ্রে ভর্তি করিয়েছেন পঞ্চম শ্রেণী থেকে। পিএসসি পরীক্ষায় পৃথা জিপিএ ফাইভ পেয়েছে! কিন্তু ক্লাসে আগে ও ভাল নম্বর পেত না! এখন সে সমস্যা নেই! প্রতি মাসে ৪ বিষয়ে কোচিংয়ের জন্য ৬ হাজার টাকা দিতে পৃথার আব্বার প্রাণান্তকর অবস্থা! কেননা তিনি মতিঝিলে প্রাইভেট একটি ফার্মে সামান্য বেতনে চাকরি করেন! সীমিত বেতন। সংসারে টানাটানি! জ্ঞান কেন্দ্রে ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজারের ওপরে! সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস। প্রতিটি ক্লাস ৪০ মিনিটের। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কোচিং। ৪ বিষয়ে পড়া বাধ্যতামূলক। তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীর মাসিক বেতন ২ হাজার, পঞ্চম হতে অষ্টম শ্রেণীর মাসিক বেতন ৩ হাজার টাকা। ভর্তির টাকা আলাদা! সকল স্তরেই ভর্তি ব্যয় ৫ হাজার টাকা! ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তা দিতে হয়। মাসে ৪ বিষয়ে পরীক্ষা জন্য ৫শ’ টাকা ছাড়াও মডেল স্টেস্ট, প্রশ্নপত্র অনুলিপির জন্য অভিভাবকদের আলাদাভাবে টাকা গুনতে হয়। মাসের শেষ সপ্তাহে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া! এ জন্য পৃথাকেও দিতে হয় ২শ’ টাকা! এ মাসের বিরিয়ানিটা ফকরুদ্দিনের! পোলাওয়ের পরিমাণ বেশি! পৃথা না খেয়ে নিজের অংশটা আজও গরিবকে বিলিয়ে দেয! স্কুলেও এমনটি করে পৃথা! শুধু কি তাই! আত্মীয়স্বজন ও পিতামাতার দেয়া টাকা সে জমিয়ে রাখে! টিফিন পিরিয়ডে সে টাকা দিয়ে সহপাঠীদের খাওয়ায়। কলম পেন্সিল রাবার সার্পনার পারেতো নিজেরটাই দিয়ে দেয়! স্কুলে একবার অন্য শাখার এক শিক্ষার্থীর ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহ করে পৃথা! ১৭ দিনে ও একাই টিফিন পিরিয়ডে অভিভাবক ও পথচারীদের কাছে ঘুরে ঘুরে ৪১ হাজার ৩৪৫ টাকা তোলে! সংগ্রহ করা টাকা গুলশান ম্যামকে দেয়। স্কুলের শিক্ষকরা পৃথাকে এ জন্য বেশ বাহবা দেয়! জ্ঞান কেন্দ্রের সবাই তা জানে। সুবিধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা ও অভুক্ত থেকে অসহায় মানুষের প্রতি ভালবাসার এ শিক্ষা কোথায় পেলে পৃথা? নাসিমা ও আয়েশা ম্যামকে বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে। ষষ্ঠ শ্রেণীর এতটুকুন মেয়ে যার কিনা প্রবল মানবতাবোধ! বিরিয়ানির বাক্সগুলো পৃথা ও তানহা বাইরে ভিক্ষুকদের দিয়ে আসে! নাসিমা ও আয়েশা ম্যাম টিচার কক্ষে বসে আলাপ করছিলেন! বিকেল হয়ে এলো! ঘরে ফেরার তাড়া সকলের। নাসিমা ম্যাম আসিয়াকে ডেকে বললেন পৃথাকে ডাকতো? পৃথাকে বসতে বললেন আয়েশা ম্যাম। বললেন - তুমি তো খাওনি বোধ হয়? আচ্ছা পৃথা তুমি না খেয়ে অপরকে তোমার খাবারটা দাও কেন? আগে তো নিজে খাবে? উদ্বৃত্ত থাকলে তারপর অপরকে দিবে! - আমরা তো খেতে পারি সবসময় ম্যাম! পথের গরিবরা তো অভুক্ত থাকে প্রায়ই! সমাজ পাঠে পড়েছি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের ধর্ম! মনীষীরা ত্যাগ করেই মহামানব হয়েছেন। পৃথার কথা শুনে শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান! নাসিমা ম্যাম অন্য কক্ষে যান! আর আয়েশা ম্যাম রিভলভিং চেয়ারে আরামে শরীরে হেলিয়ে দেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন! ডান হাতটা গালে রেখে টিচার কক্ষে জ্ঞান কেন্দ্রের একমাত্র শীতাতপ যন্ত্রটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন! - ম্যাম আসি? মাথা নাড়লেন ম্যাম। বাসায় ফেরার জন্য তানহাকে নিয়ে পৃথা কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে পড়ে।
×