ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুখ শরীর মাথা ঢেকে চলছেন সবাই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আক্রান্তের ভয়ে বাসাবাড়িতেও দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা

করোনায় বদলে গেছে জীবনাচার, কাউকে চেনার উপায় নেই

প্রকাশিত: ২২:১৮, ২৭ জুন ২০২০

করোনায় বদলে গেছে জীবনাচার, কাউকে চেনার উপায় নেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মুখে মাস্ক। চোখে চশমা। তারপর আবার ঢাকনা ওয়ালা গ্লাস। হাতে গ্লাভস। গায়ে পিপি। মাথা কখনও খোলা থাকলে তাও ঢাকনা দিয়ে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা। করোনা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এটাই এখন বদলে যাওয়ার প্রচ্ছদ। অর্থাৎ পরিচিত বা অতিপ্রিয় মানুষ একজন আরেকজনকে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। হয়তো পাশ দিয়েই যাচ্ছেন। আগে প্রতিদিন কথা হতো। হতো কুশল বিনিময়। এখন আর তেমনটি কমই হয়। যে যার মতো করে বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে চলছেন। চোখ আর কণ্ঠস্বর হয়তো কোন কোন সময় পরিচিত জনের পথচলার আভাস দেয়। চেনার পথ তৈরি করে। অর্থাৎ করোনায় বদলে গেছে মানুষের জীবনাচার। এত গেল নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটি পর্ব। আরেকটি পর্ব হলো ঘরে-বাইরের। একটু পরপর হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার মাখা থেকে শুরু করে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পথচলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী এখন অনেকেই ঘরে মাস্ক পরতে শুরু করেছেন। কারণ ঘরে থেকেও আক্রান্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। আবার যারা অফিস করছেন তাদেরও নিজেকে নিরাপদ রাখতে চেষ্টার যেন কোন শেষ নেই। করোনাকালে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে বিরাট পরিবর্তন। ভিটামিন সি যুক্ত খাবার এখন সবাই বেশি করে খাচ্ছেন। ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে শুরু করে নামী-দামী হোটেল রেস্টুরেন্টে বেচাকেনা কমেছে আশঙ্কাজনকহারে। করোনা থেকে বাঁচতে লবণযুক্ত গরম পানির গরগরা, গরম পানি খাওয়া, লেবুর শরবত, মৌসুমি ফল, সবজি বেশি বেশি খাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। আবার বাজারে কম গিয়ে কিভাবে চলা যায় সে অভ্যাসও ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। একদিন বাজারে গিয়ে অন্তত ১৫ দিনের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে আনছেন। এর বাইরেও রাস্তায় কোন অবস্থাতেই থু থু ফেলা যাবে না। হাচি বা কাঁশি দেয়ার সময় কনুই ভাজ করে বা নাকে-মুখে রুমাল চেপে দিতে হবে। ব্যবহৃত জিনিসপত্র সাবান দিয়ে ধোয়া মোছা বাধ্যতামূলক। ঘার-বাড়িসহ অফিস পরিষ্কার রাখা। ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভস ফেলতে হবে বিনে। বারবার হাত ধুতে হবে ২০ সেকেন্ড। প্রয়োজনের তাগিদেই এসব কিছু করতে হচ্ছে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দেদার বিক্রি বেড়েছে সুরক্ষা সামগ্রীর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোটা বিশ^কে থামকে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও বদলে যাওয়া জীবনে মানুষকে অভ্যস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অনভ্যাসকে পরিণত করতে হবে অভ্যাসে। মানিয়ে নিতে হবে একা থাকা ও চলা। চীনের বেজিং ও নিউজিল্যান্ডে করোনার প্রভাব কমতে শুরু করলেও ফের ফিরছে। তাই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় সব রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর করোনার টিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে গোটা পৃথিবীর মানুষ। এর আগে প্রতিরোধে সকল অভ্যাস জীবনের সঙ্গে প্রতিদিনের জন্য মানিয়ে নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডাঃ বর্ধন জাং রানা বলেছেন, করোনা সঙ্কটের কারণে মানুষের নতুন জীবন ধারা মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, জীবনাচারের নতুন স্টাইল এখন বিশ্বজুড়ে। মানুষকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে। তাই নিজেকে সব সময় নিরাপদ রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধিটাই আসল বিষয়। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা মানেই পরিবার সুরক্ষিত থাকবে। এজন্য অভ্যাস বদল করা কষ্টসাধ্য হলেও আমাদের সামনে টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কোন বিকল্প নেই। তবে আমরা আশাবাদী এই সঙ্কট থাকবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে গোটা পৃথিবীর মানুষ। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান প্রদেশে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। প্রায় ছয় মাসে গোটা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয় কোভিড-১৯। এখন প্রাণঘাতী এই ভাইরাস গোটা দুনিয়ার জন্য মহা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা শত চেষ্টাতেও ভাইরাস রোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করতে পারছেন না। নোভেল করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল। মহাবিপর্যয়ের মুখে বিশ্ব অর্থনীতি। ইউনিসেফ বলছে করোনার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ৬০ কোটি শিশুর ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ছুঁই ছুঁই। মারা গেছেন চার লাখ ৯২ হাজারের বেশি। সুস্থ হয়েছেন ৫২ লাখ ৬২ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত ও মৃত্যু বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৭তম। সামনের দিনগুলোতে দেশে করোনার মহামারী আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া চীনের প্রতিনিধি দলও করোনা প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছে সরকার অন্ধকারে ঠিল ছুড়ছে। এই অবস্থায় দেশেও দিন দিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর বহর দীর্ঘ হতে চলেছে। ডাঃ জাফরউল্লাহ বৃহস্পতিবার বলেছেন, দেশে এখনও করোনার পিক টাইমস আসেনি। আগামী মাসে পিক টাইম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একদিনে আরও ৪০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৬১ জন। শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮৬৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৪৭৪ জনে। আইইডিসিআরের অনুমিত হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে আরও ১ হাজার ৬৩৮ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ১৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা শুক্রবার দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এ সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ, তার দশ দিনের মাথায় প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। ১৮ জুন দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। নাসিমা সুলতানা জানান, গত একদিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৩১ জন পুরুষ ও ৯ জন নারী। তাদের মধ্যে ৩১ জন হাসপাতালে, ৯ জন বাড়িতে মারা গেছেন। করোনার ছোবলেও মধ্যে আসলে কেমন করে বদলে গেলাম। কতটা বদলে গেলাম। তাছাড়া বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতাও কি ধরে রাখা সম্ভব। কতটা রয়েছে মানসিক প্রস্তুতি বা সমাজে বদলে যাওয়ার চিত্র। করোনায় মোট আক্রান্তের মধ্যে রাজধানীর একটা বড় অংশ। মৃত্যুর তালিকা বিবেচনা করলে রাজধানী এগিয়ে। এই শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাঁচার প্রয়োজনে এখন অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পথ চলেন। যদিও উল্টো চিত্রও দেখা যায়। তবে মেনে চলার সংখ্যাই বেশি। কতটা মানছেন তারা বা পারছেন? একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করেন বিশ্বজিৎ রায়। প্রতিদিন বাসাবো থেকে যেতে হয় নতুন বাজার। করোনা রোধে মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, আই গ্লাসসহ সব ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন তিনি। বলেন, এখন পরিচিতজনদের সহজে চেনার কোন উপায় নেই। করোনায় বদল দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। তিনি বলেন, আমরা দুই বন্ধু একসঙ্গে প্রায়ই অফিস যেতাম। এখন এমন সময় হয় ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও চিনতে পারি না। চোখ আর কণ্ঠস্বর বন্ধুত্বের জানান দেয় অনেক সময়। কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ী আরফান মিয়া জানালেন, করোনায় মানুষের চেহারা, পোশাক ও চলনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কাছের লোকদের সহজে চিনতে পারি না। তিনি মজা করে বলছিলেন, সম্প্রতি আমার ছেলে সুরক্ষা সামগ্রী পরে দোকানে জিনিস কিনতে আসে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে টাকা রেখে সদাই বিক্রি করি। ছেলে যাবার সময় আমাকে বলে আব্বা তুমি আমার থেকেও রাখলে? মতিঝিলে একটি বেসরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রিয়ান। তিনি জানালেন, কোভিড থেকে বাঁচতে জীবনযাত্রার সঙ্গে এখন পোশাকের ব্যবহার বদলে গেছে। বাসায় শিশুরা শরীর ঢাকা পোশাক দেখে অনেক সময় ভয় পায়। বাইরে প্রতিদিন যেতে হয়। তাই বাসায় ফেরার পর মুখে মাস্ক থাকে। সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য একটু দূরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু এতে তারা মনে মনে কষ্ট পায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, গত কয়েক মাস অফিসে থাকতে হচ্ছে। এখানেই খাওয়া দাওয়া চলে। বাসায় যেতে পারছি না। সন্তানরা বারবার টেলিফোন করছে। কান্না করছে। বলছে, বাবা কবে আসবা। তুমি না আসা পর্যন্ত ভাত খাব না। কিন্তু নানা কথা বলে ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখতে হচ্ছে। সময়ের কারণে নিজেকে মানিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মাস্ক, গ্লাসের কারণে মানুষের মুখম-ল করোনায় চেনা কঠিন হয়ে গেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত আসামি ধরতেও হিমশিম খাচ্ছে। এখন সমাজের সব স্তরের মানুষই নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনা প্রতিরোধে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে যেসব অভ্যাস গড়ে উঠেছে তা থেকে সহজেই মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ মুখে মাস্ক, হাত ধোয়া, পিপিই গায়ে দিয়ে পথ চলতে হবে। বারবার সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া ও খাদ্যাভাস হবে নতুন নিয়মে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি সঙ্কট কেটে যাবে। কিন্তু কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। অনেক দেশে আক্রান্ত কমে গিয়ে ফের বাড়ছে। তাই কিছুটা কমলে নিজেকে আগের অবস্থায় নেয়া যাবে না। সর্বোচ্চ সচেতন থেকে চলতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে হাল ছেড়ে না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক টেড্রোস আডানম গেব্রিয়েসাস। সম্প্রতি একটি অনলাইন ব্রিফিংয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। মহাপরিচালক বলেন, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে মহামারী চলছে। এখন কোন দেশের হাত-পা গুটিয়ে থাকার সময় নয়। তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বের মহামারী পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ডব্লিউএইচওর এপিডেমিওলোজিস্ট মারিয়া ভ্যান কারখোভ ব্রিফিংয়ে বলেন, দক্ষিণ আমেরিকায় করোনা মোকাবেলায় বিস্তৃত পদক্ষেপ প্রয়োজন। মহামারী শেষ হতে এখনও অনেক দেরি আছে।
×