ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী

উত্তরাঞ্চলে বন্যা ॥ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

প্রকাশিত: ২২:১৬, ২৭ জুন ২০২০

উত্তরাঞ্চলে বন্যা ॥ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েক জেলায় বন্যার প্রকোপ শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ইতোমধ্যে যমুনা, তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এসব নদী অববাহিকায় নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যে বন্যার কবলে পড়ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫০ হাজার মানুষ। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এসব এলাকায় বন্যার প্রকোপ আরও বাড়বে। এই সময় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তারা জানিয়েছে, এসব এলাকায় নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি উঠে গেছে। তবে এসব এলাকায় বন্যার স্থায়িত্ব স্বল্পমেয়াদী হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, কিছু পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনে এসব নদীর পানি আরও বাড়বে। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারি, লালমনিরহাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় নিম্নাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ শুরু হয়েছে। উজানে ভারিবর্ষণে বহ্মপুত্র-যমুনার পানি বাড়তে থাকায় আগামী ১০ দিনের মধ্যে দেশের আট জেলার অনেক এলাকা পাঁচ থেকে সাত দিনের বন্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে। এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত পূর্বাভাসে জানিয়েছে, বহ্মপুত্র ও যমুনার পানি আগামী ১০ দিন বাড়তে পারে। তারা জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ ও সোমবারের মধ্যে যমুনার পানি গাইবান্ধার ফুলছড়ি, জামালপুরের বাহাদুরাবাদে, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে এবং টাঙ্গাইলের এলাসিনে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হতে পারে। এর ফলে এ জেলাগুলোতে নদী সংলগ্ন এলাকার নিম্নাঞ্চলে স্বল্প মেয়াদী বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, গঙ্গার পানি বাড়লেও আপাতত কোন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে মুন্সীগঞ্জ জেলার ভাগ্যকূল পয়েন্টে এবং রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এসব জেলায়ও স্বল্পমেয়াদী বন্যার শঙ্কা রয়েছে। এ সময়ে ঢাকার আশপাশের নদ-নদীর পনি বাড়লেও বিপদসীমা অতিক্রমের শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামান। এদিকে আগামী কয়েকদিন দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। তারা জানায় দেশের উত্তরাঞ্চলে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগ এববং বগুড়া অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। তারা জানায়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, হরিয়াণা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ হয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশে উত্তরাঞ্চলের ওপর এটি বেশ সক্রিয়। তবে অন্যান্য এলাকায় কম সক্রিয় এবং উত্তরবঙ্গোপ সাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে রাজশাহী, রংপুর ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশালের দুএক জায়গায় বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে মৌসুমি সক্রিয় থাকার কারণে উত্তরাঞ্চলে বেশ কিছু জেলায় ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে দেশের ভেতরে ভারির বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে নদীতে পানি বাড়ছে। ফলে উত্তরের বন্যা দেখা দিয়েছে। নদীগুলোর পানি আগামী ১০ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বাড়তে পারে। ফলে বন্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। কুড়িগ্রাম ॥ অবিরাম বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়াও জেলার ছোট-বড় অন্যান্য নদ-নদীর তিস্তা, গঙ্গাধর, দুধকুমারসহ শঙ্খ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চল এবং অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার নিচু বাড়িঘরে ইতিমধ্যে পানি উঠেছে। এছাড়া চরাঞ্চলের সব বাড়ির চার দিক বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার মানুষ। মূল স্থলভাগের সঙ্গে নৌকা আর ভেলায় যোগাযোগ স্থাপন করছে তারা। জেলার নাগেশ্বরী, সদর, ভুরুঙ্গামারী, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুরসহ উলিপুরের কিছু কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার চলতি মৌসুমের ফসলি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে পাট, ভুট্টা, সবজি ও মাঠে কাজ করছে। এ পর্যন্ত দুই উপজেলার পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। যাতে ৩৭ হেক্টর আউশ, ৯৩ হেক্টর তিল এবং ৬ হেক্টর মরিচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুল ইসলাম জানান, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। লালমনিরহাট ॥ ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি দোয়ানির ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার নদীর পানি বৃদ্ধিতে ভাটিতে চরাঞ্চলের বন্যা দেখা দিয়েছে। নদী কূলবর্তী গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি দোয়ানির ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ভাটিতে থাকা চর ও দ্বীপচরে বসবাসরত গ্রামবাসীদের নিরাপদ দূরুত্বে সরে যেতে বলা হয়েছে। উজানের বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢল সামাল দিতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। নিচু চরগুলোতে বুক পানি উঠে গেছে। তিস্তার বিভিন্ন চরাঞ্চলের ১০ হাজার পরিবার ইতোমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিস্তার অববাহিকার ২০টি চরাঞ্চল ও গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঠাকুরগাঁও ॥ অবিরাম বৃষ্টি আর উজানের পানির ঢলের কারণে ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গনসহ অন্যান্য নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। তীরে বসবাসরত প্রায় পাঁচ শ’ পরিবারের ঘর-বাড়ি প্লাবিত হয়েছে এবং পানিবন্দী পরিবারগুলো শিশু ও প্রবীণদের নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ভুক্তভোগীরা এই দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতে জরুরী ভিত্তিতে সরকারী সহায়তা চেয়েছেন। আর জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। বুধবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর অবধি ঠাকুরগাঁওয়ে অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি ঝড়েছে। সেইসঙ্গে উজানের পানির ঢলের কারণে স্থানীয় টাঙ্গন নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে শহরের পার্শ্বে নিম্নাচলের খালপাড়া, ডিসি বস্তি, জলেশ্বরীতলা, হঠাৎপাড়াসহ কয়েকটি মহল্লা প্লাবিত হয়েছে। বর্ষা শুরু হলেই প্রতিবছর যেন পানিবন্দী হয়ে দুর্ভোগে না পড়েন- এমনই স্থায়ী ব্যবস্থার দাবি করেছেন নদীর তীরে বসবাসকারীরা। নীলফামারী ॥ তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার ডিমলা, জলঢাকা উপজেলার নদী বেষ্টিত প্রায় ১৫টি চরাঞ্চল গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বুড়ি তিস্তা, দেওনাই, চাড়ালকাটা, ধাইজান, খড়খড়িয়া যমুনেশ্ব^রীসহ সকল নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভারি বৃষ্টির কারণে নিমাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় আসন্ন আমন মৌসুমির বীজতলা তলিয়ে যাওয়ায় ধানচাষীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা তিস্তা নদীর অববাহিকায় বসবাসকৃত মানুষজনের ওপর নজরদারি করছি। এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। নীলফামারীর তিস্তা অববাহিকায় সরকারীভাবে প্রায় ১২ নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যখন যার প্রয়োজনে সেই নৌকাগুলো বন্যাকবলিত পরিবারকে সহায়তা করা হবে। তিনি সরকারী ত্রাণের বিষয়ে জানান পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী মজুদ রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকায় যাতে পানির সঙ্কট না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে।
×