ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঔষধি গুণসম্পন্ন, স্বাদে টক কষ্টা- এ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ২৭ জুন ২০২০

ঔষধি গুণসম্পন্ন, স্বাদে টক কষ্টা- এ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর ‘চেরি ফল’। নাম শুনে মনে হবে বিদেশী। আসলে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে দেশেই ফলছে এই ফল। দেশে এর নাম করমচা। এটি একাধিক জাতের হয়। বর্ষা মৌসুমে এই ফল নীরবে নিভৃতে গ্রামের ঝোপঝাড়ে ফলে থাকে। কখনও বনফুলের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে। করমচা দেখতে চেরি ফলের মতো হওয়ায় অনেক আগে থেকেই এক শ্রেণীর ধুর্ত ব্যবসায়ী কৌশলে এটি প্রসেস করে বয়ামে ভরে ‘চেরি নামে’ খোলা বাজারে অর্থাৎ সুপারশপে বিক্রি করছে। লালচে রঙের দেখতে সুন্দর ছোট আকৃতির ফলের স্বাদে টকের সঙ্গে হাল্কা মিষ্টির আলাদা ফ্লেভার। কোন কোন জাতের করমচা বেশি টক ও কষ্টা স্বাদের হয়ে থাকে। ইদানিং সৌখিন মানুষের ছাদ-বাগানে সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে ফলছে ‘চেরি’ নামধারী করমচা। বর্তমান করোনাকালে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে (এ্যান্টিবডি) চেরি নামের করমচা অন্যতম ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। বগুড়ার ফল ও পুষ্পপ্রেমী সুরভী নাসরিন বললেন ‘বাঙালীর চেরি দেখতে যেমন সুন্দর স্বাদেও ভাল আবার করোনা মোকাবেলার যোদ্ধা।’ ছাদ-বাগানে টবে করমচা ফলিয়ে তিনি খুশি। বললেন, অনেকে করমচার আচার বানিয়ে বয়ামে রাখে। আচারের স্বাদ খুব ভাল। উদ্যানতত্ত্ববিদ রওশন আক্তার বললেন, টক স্বাদের এই ফল খাওয়া যায়। কাঁচা ফল সবুজ। পরিণত অবস্থায় হয় লালচে রঙের। করমচার ঝোপ দেখতে সুন্দর। বিলুপ্তির পথেই যাচ্ছিল। চেরি ফুলের মতো হওয়ায় প্রথমে নান্দনিকতার ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন হয়। গ্রামে অনেকে বাড়ির সীমানা দেয়। তারপর ফলের তালিকায় যুক্ত হয়। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। চাষও করা যায়। বর্তমানে শহরের বাসাবাড়ির ছাদে সৌখিন বৃক্ষপ্রেমীরা টবে করমচা ফলাচ্ছে। ছাদও দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে ফলও মিলছে। কৃষি বিজ্ঞানী এ কে এম জাকারিয়া বললেন, বাঙালীর চেরি করমচা ফল হিসেবে অবহেলিত ছিল। পুষ্টিবিজ্ঞানীগণ খুঁজে পেলেন করমচার পুষ্টিগুণ মোটেও অবহেলার নয়। প্রতি এক শ’ গ্রাম করমচায় আছে এনার্জি ৬২ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৪০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট, ভিটামিন সি ৩৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি। এর সঙ্গে আছে নিয়াসিন, রিবোফ্লেভিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, কর্বোহাইড্রেট। করমচার বহুগুণাবলি রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিস রোগীদেরও উপকারি। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ কমিয়ে দেয়। যকৃত ও কিডনির রোগ প্রতিরোধ ও দূষণ পরিষ্কারে সহায়ক। কোন ফ্যাট (কোলেস্টরেল) নেই। করমচার রস সর্দিকাশি জ্বর-জারি উপশম করে। করমচার বিজ্ঞান নাম ক্যারিসা ক্যারোন্ডাম। ইংরেজী নাম ক্রিস্টসথর্ন। কাঁটাযুক্ত গুল্মজাতীয় এই গাছের আদিনিবাস নিয়ে বিতর্ক আছে। কোন প্রজাতি ভারতবর্ষের। কোন প্রজাতি মিসর ও দক্ষিণ আফ্রিকার। তবে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে এই গাছ বেড়ে ওঠে। বিশ্বে করমচার ১৫৫ বর্ণের ও গোত্রের গাছ আছে। যার মধ্যে চেরিও অন্তর্ভুক্ত। ডিসম্বের জানুয়ারিতে রোপণের পর ফেব্রুয়ারিতে ফুল আসে। ফুল দেখতে সাদা ও ফিকে গোলাপি। মিষ্টি গন্ধ। এপ্রিল ও মে মাসে ফল ধরে বর্ষায় লালচে হয়ে পাকে। ভেতরে চেরি ফলের মতো ছোট্ট ৪/৫টি বীজ থাকে। ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ আবু হায়দার বললেন, ভারতবর্ষের আদি চিকিৎসাশাস্ত্রে চরকের উল্লেখ আছে। পাশাপাশি করমচার বহুমুখী গুণাগুণ ভেষজ চিকিৎসায় অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন বা আদি চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেষজ গুণাগুণ সমৃদ্ধ গাছগাছালি খুঁজে বের করা হতো। বর্তমানেও এসব গাছ নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে। ডাঃ এমদাদ হোসেন বললেন, এ্যালোপ্যাথি ওষুধের অনেক ফর্মূলা আসে ঔষধি গাছগাছালি থেকে। ভেষজ কোন বৃক্ষের কি গুণাগুণ তা নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক ওষুধ কোম্পানি হারবাল মেডিসিন প্যাকটেজাত করছে। সর্দ্দিকাশি জ্বরজারির জন্য তুলসি পাতার রস, লং দারুচিনি এলাচি তেজপাতা ইত্যাদি ওষুধের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কালোজিরা আদা রসুন কোনটিই বাকি নেই। মাত্রা মেপে এসব খেলে কোন ক্ষতি নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে উপকার আছে। করোনার এই সময়ে চায়ের মধ্যে আদা লং তেজপাতা দারুচিনি মিশিয়ে পান করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। করমচা অনেক পুরোনা গাছ। এর গুণাগুণও আছে। গ্রামের মানুষ আজও রোগ ব্যাধিতে নিম পাতা ব্যবহার করে। করমচা সম্পর্কেও জানে।
×