ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. কাজী এরতেজা হাসান

বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২৭ জুন ২০২০

বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অর্থনীতির উদীয়মান টাইগার। সারাবিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার কারসাজির পরও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করার মাধ্যমে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী। আমাদের মতো উদীয়মান একটি অর্থনৈতিক শক্তিকে প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক পত্রিকা (আনন্দবাজার) বাংলাদেশকে অসম্মান করে ‘খয়রাতি’ শব্দ ব্যবহার করে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এমন একটি দুঃখজনক সংবাদ আমার দৃষ্টিগোচর হলেই বুকের মধ্যে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করি। যে পত্রিকাটি আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চমৎকার সংবাদ পরিবেশন করেছিল, সেই পত্রিকাটিই কিভাবে স্বাধীনতার ৫ দশক পরে বাংলাদেশকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন সংবাদ প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে নানাজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমি বিষয়টা নিয়ে প্রতিবাদ করার উপায় খুঁজতে থাকি। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। আমি প্রথমেই যোগাযোগ করি আমাদের অতি আপনজন ও প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত সেনানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেনের সঙ্গে। আমি যতবারই প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি, প্রতিবারই তিনি আমাদের আপন করে নিয়েছেন। একবার ঈদের দিন পুরো প্রতিনিধি দলকে নিজের বেতনের টাকায় কেনা কোরবানির খাসি দিয়ে একটি হোটেলে তিনি দাওয়াত দিয়েছিলেন। শেখ রাসেলের নামে দেয়া কোরবানির মাংস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘মোমেনকে এবার দেশে নিয়ে যাব।’ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, এ কে এম আবদুল মোমেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দিবেন। তিনি আজ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আমি যখন ফোন করে তাকে বললাম, কলকাতার একটি পত্রিকা বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন একটি আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছে। আমরা এর প্রতিবাদ করতে চাই। তখন তিনি জানতে চাইলেন, কিভাবে? এটা তো রাষ্ট্রীয় কোন বিষয় নয়। তখন তাকে বললাম, আমাদের নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের মাধ্যমে আপনারা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারেন। তখন তিনি রাজি হয়ে যান এবং তিনি সংলাপে চমৎকারভাবে বলেছেন, বাংলাদেশকে অসম্মান করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই সংবাদ পরিবেশন করেছিল পত্রিকাটি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র। আমরা মনে করি, আমাদের উন্নয়ন হলে ভারতেরও উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমাদের ‘খয়রাতি’ শব্দ ব্যবহার করে দুঃখ পেয়েছি। বিশ্বের বহু উন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এমন শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে। চীনও তেমনভাবেই দিয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে পুরো বিশ্বের মতোই আমাদের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিষয়ে। এরপর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চীনের মতো ভারতের সঙ্গেও আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, বিশাল দেশের একটি আঞ্চলিক পত্রিকা একটা কিছু লিখলে এটা নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই। ভারত আমাদের আত্মার আত্মীয়। একে অপরের উন্নয়ন হলে আমরা সবাই ভাল থাকব। ভারত সরকার এ বিষয়ে আমাদের কিছুই বলেনি। এরপর ফোন করেছিলাম তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে। তিনি বললেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে কথা বলবেন, সেখানে আমার কিছু বলার থাকে না। তবে বাংলাদেশের কোন মানুষই চায় না, ভারত বিদ্বেষীভাব প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়; বজায় রেখে আমরা উন্নয়ন করতে চাই। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে যখন বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছি, তখন কেন আমরা অন্য দেশের সঙ্গে বিদ্বেষমূলক আচরণ করব। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চাই। কোন পত্রিকা খয়রাতি বা ভিক্ষুক লিখলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। কারণ সারা বিশ্বই জানে বাংলাদেশ এখন কোথায়। আমাদের অর্থনীতি এখন উদীয়মান বাঘের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত যেখানে ২০১৪ সালে ডিজিটাল দেশগড়ার কথা বলেছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৮ সালেই একথা বলেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন ইন্দো-বাংলা চেম্বারের সভাপতি এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মাতলুব আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে আনন্দবাজার ভারত নয়, ভারতও আনন্দবাজার নয়। ভারতের পুরো দেশে আনন্দবাজার খুব কম লোকই পড়ে। আমরাই বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমাদের না ভেবে আরও বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়নের শীর্ষে উঠে যাচ্ছে, এটা দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত। বাংলাদেশ কিন্তু ভারতের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয় করেছে, ছিটমহলও বিনিময় হয়েছে। এখন চীন পণ্যে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু ভারত তো শতভাগ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা ২০১১ সালেই দিয়েছিল। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, আনন্দবাজার বাংলাদেশের মানুষকে আহত করেছে। ভারতের এই নিউজটি করা হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন ভারত-চীনের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা রয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এটা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের গভীরতা অনেক। বাংলাদেশ এখন এমন একটি জায়গায় রয়েছে, আমরা কাউকে বাধ্য নই সমর্থন দিতে। কিন্তু পাকিস্তান চীনের কাছ থেকেই যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে থাকুক, তা ফেরত দিতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সেই অবস্থানে নেই। ভারত-চীনের মতো বড় দেশগুলো যখন যুদ্ধাবস্থায় তখন আমাদের কৌশলগতভাবে এগুতে হবে। আনন্দবাজারের ঢাকা প্রতিনিধি (ডিজিটাল অনলাইন বিভাগ) সাংবাদিক অঞ্জন রায় বলেন, আমি আনন্দবাজার পত্রিকার ডিজিটাল মাধ্যমের দায়িত্বে রয়েছি। আনন্দবাজারে ঢাকা থেকে কোন নিউজ গেলে সেখানে ডিজিটাল লেখা থাকে। উল্লিখিত সংবাদটি আমার পাঠানো নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমাকেও সংবাদটি আহত করেছে। আমিও কষ্ট পেয়েছি। প্রথমে আমার দেশ। আমার দেশ সম্পর্কে কোন অবাঞ্ছিত কথা বললে তা আমি মানতে পারব না। বাংলাদেশ এখন আগের মতো নেই। এখন কোন দেশে দুর্যোগ হলে উড়োজাহাজে করে ত্রাণ পাঠানো হয়। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু করছে। সেখানে অসম্মানজনক উক্তি কাম্য নয়। এটি অবশ্যই দুঃখজনক। তবে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘খয়রাতি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে এই ক্ষমা চাওয়াটা আমাদের বিজয় বলে গণ্য করতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক সৈনিক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে এটাকে আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। এর আগেও জাতির পিতাকে অবমাননা করার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করার পর মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলাম। দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পর সেই বইগুলো রিটকারী হিসেবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট। এটাও আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল ছিল। এবার নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে আবারও বীরের জাতি বাংলাদেশীদের বিজয় হলো। আমাদের এই লড়াইয়ের কারণে আনন্দবাজারের মতো পত্রিকাকেও ক্ষমা চাইতে হয়েছে। আমাদের এই বিজয় পুরো বাংলাদেশীদের বিজয়। লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প বাণিজ্য ও ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য
×