ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মর্যাদা প্রাপ্তির ২১ বছরে পা পড়ল

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৭ জুন ২০২০

মর্যাদা প্রাপ্তির ২১ বছরে পা পড়ল

মিথুন আশরাফ ॥ দেখতে দেখতে সময় চলে গেল। এক এক করে ২০টি বছর চলে গেছে। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা প্রাপ্তির ২০ বছর হয়ে গেছে। আজ থেকে মর্যাদার প্রাপ্তির ২১ বছরে পা পড়ল দেশের ক্রিকেটের। বিশ বছর আগে ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের কুলীন যুগে পা রাখা নিশ্চিত হলো। এদিনই যে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের নতুন সদস্য হলো, সেই ঘোষণা এলো। লর্ডসে অনুষ্ঠিত আইসিসির সভায় টেস্ট মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। তা ঘোষণাও করেন তৎকালীন ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি ম্যালকম গ্রে। আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ পেতে, এ মর্যাদা পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে অবশেষে মিলেছে এই প্রাপ্তি। অনেক অপেক্ষার ফল ছিল সেটি। শুরুতে এ প্রাপ্তির জন্য ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বিসিবির তৎকালীন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ঘোষণা দেন, তিন বছরের মধ্যে টেস্ট মর্যাদা পেতে চাই। এজন্য ১৯৯৮ সালে ইনডিপেনডেন্স কাপ আয়োজন করা হয়। এমনকি মিনি বিশ্বকাপ (যেটি পরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়) আয়োজন করা হয়। বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কী উন্মাদনা আছে। পৃষ্ঠপোষকেরও অভাব নেই। ক্রিকেট নিয়ে সংবাদমাধ্যমেরও আছে অনেক আগ্রহ। এভাবে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি দেশের বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও কর্মকর্তাদের বোঝানো হয়। টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। ক্রিকেটে এগিয়ে যেতে হলে, ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে হলে এই প্রাপ্তি দরকার। তাহলে দেশের ক্রিকেট আরও এগিয়ে যাবে। অবশেষে ২০০০ সালের ২৬ জুন আসে সেই দিন। আইসিসির সভায় বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন সাবের হোসেন চৌধুরী। লর্ডসের লং রুমে সেই সভা হয়। প্রেজেন্টেশন দেয়া হলো। নিজেদের দাবির পক্ষে বক্তব্য রাখা হলো। বিসিবির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হকও সেই সভায় উপস্থিত থাকেন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের সমর্থন আগে থেকেই ছিল। সহযোগী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কেনিয়া তখন বাংলাদেশের সঙ্গেই ছিল। বাংলাদেশের আগে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া জিম্বাবুইয়েও স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন করে। বাকি বোর্ডগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড বোর্ডের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান ডেনিস রজার্স, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান জন এ্যান্ডারসন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী বাখারও সমর্থন দেন। সাবের হোসেন প্রত্যেক বোর্ডের সভাপতির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। যোগাযোগ চালিয়ে যান। তখন একটি কৌশলই বিশেষভাবে অবলম্বন করা হয়েছিল। তা হচ্ছে সবাইকে বোঝানো যে আবেদনটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের স্বার্থেই। বাংলাদেশ টেস্ট জাতি হলে বিশ্ব ক্রিকেটই লাভবান হবে। তখন জগমোহন ডালমিয়া, আলী বাখাররা ক্রিকেটের বিশ্বায়ন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশের ভাবনার সঙ্গে তা মিলে যায়। বেশিরভাগ বোর্ড যখন রাজি হয়ে যায়, তখন আইসিসির তৎকালীন সভাপতি ম্যালকম গ্রে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের তখনকার অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলও উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশ পুরোপুরি তৈরি ছিল না। তবে সহযোগী দেশ হিসেবে যে প্রস্তুতি থাকতে হয়, সেই প্রস্তুতি ছিল। বাকিটা খেলতে খেলতে হয়ে যাবে। আর টেস্ট মর্যাদা না পেলে তো একটি পর্যায়ে যাওয়া যাবে না। তাই বোঝা হয়েছিল, আইসিসি সভায়। তা কাজেও লাগে। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদাও পেয়ে যায়। সেই মর্যাদার ২০ বছরও হয়ে গেছে। আজ পথ চলার ২১ বছরের শুরু। বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোকে বলেছেন, ‘আমাদের অবিশ্বাস্য কিছু করতে হতো। আমরা পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। সহযোগী দেশ হলেও শীর্ষে পৌঁছানোর স্বপ্ন ছিল আমার। জিম্বাবুইয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস চাওয়ার আগে তিনবার আইসিসি ট্রফি জিতেছিল। টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলে জিম্বাবুইয়ের ক্রিকেট মারা যেত। যে মুহূর্তে আমরা আইসিসি ট্রফি জয় করেছিলাম, ঠিক তখনই ডেভিড রিচার্ডকে আমি বলেছিলাম, আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলতে চাই। তিনিও আমাদের কথা শুনেছেন এবং আমাদের সাহায্য করেছেন।’ বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় লড়াইটি এবং মর্যাদা পাওয়ার পথ আরও সহজ করেছেন ক্রিকেটাররা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় টেস্ট প্রাপ্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। আইসিসি সভার ভোটাভুটিতে জয় নিশ্চিত পেতে তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতি জাগমোহন ডালমিয়ার কাছে সাহায্যও চেয়েছিলেন সাবের হোসেন। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর পাঁচ মাসের মধ্যে, একই বছরের ১০ নবেম্বর ভারতের বিরুদ্ধেই নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ১১৯ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। ১৪ জয় মিলেছে। ১৬ টেস্টে ড্র করেছে বাংলাদেশ। বাকি ৮৯ ম্যাচে হার। এই সময়ের মধ্যে আয়ারল্যান্ড বাদে সব দেশের বিরুদ্ধেই টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি ২০ টেস্ট খেলেছে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। একটি জয় মিলেছে। সেটিই বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচে জয় মিলেছে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ঐতিহাসিক জয় মিলেছে। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ৭, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৪, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও একটি করে জয় মিলেছে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় হয়েছে ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে। এরপর দ্বিতীয় টেস্ট জয় পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ৯৫ রানে জিতে বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট জয় করে বাংলাদেশ। পরের টেস্টেই আবার ৪ উইকেটে জিতে প্রথমবার কোন টেস্ট সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশও করে। ৪ বছর পর, ২০১৩ সালে চতুর্থ টেস্ট জয় যখন হয়, তখন হারারেতে জিম্বাবুইয়েকে ১৪৩ রানে হারায় বাংলাদেশ। পরের বছরই দেশের মাটিতে জিম্বাবুইয়েকে টানা তিন টেস্টে হারায় বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে ৩ উইকেটে, দ্বিতীয় টেস্টে ১৬২ রানে ও তৃতীয় টেস্টে ১৮৬ রানে জিতে বাংলাদেশ। তিন বছর পর ইংল্যান্ডের মতো দলকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১০৮ রানে হারায় বাংলাদেশ। এরপর কলম্বোয় শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারানোর পর ২০১৭ সালেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ২০ রানে জিতে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে জিম্বাবুইয়েকে ২১৮ রানে হারানোর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেশের মাটিতে দুই টেস্টে ৬৪ রান এবং ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারায় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো কোন দলকে ইনিংসে হারায় বাংলাদেশ। অনেক বড় প্রাপ্তি মিলে। তবে গত বছর যে টেস্ট অঙ্গনে একেবারে নতুন পা দেয়া আফগানিস্তানের কাছে ২২৪ রানে হারে বাংলাদেশ, তা অপ্রাপ্তির খাতায় বড় করেই লেখা থাকবে। এখন তো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে খেলাই বন্ধ হয়ে আছে। একের পর এক ম্যাচ, সিরিজ স্থগিত হচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর স্থগিত হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ডের সিরিজও স্থগিত হয়েছে। শুরুতে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ড সফর স্থগিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজও স্থগিত হয়েছে। সামনে বাংলাদেশ এ বছর আর কোন টেস্ট খেলতে পারবে না। তা নিশ্চিতই হয়ে যাচ্ছে। আর কোন টেস্ট যে এ বছর সূচীতে নেই। তবে টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির ২০ বছর অতিক্রম করে ফেলেছে বাংলাদেশ। ২১ বছরে পা দিচ্ছে।
×