ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে আত্মঘাতী

প্রকাশিত: ১৯:১৪, ২৭ জুন ২০২০

ঢাকায় কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে আত্মঘাতী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে এবার কোরবানির পশুর হাট বসবে কিনা সে নিয়ে দ্বিধা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণে ১৪টি এবং উত্তরে ১০টি হাট বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যে সংখ্যা গত বছরের প্রায় সমান। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে কোরবানির পশুর হাট ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে। এবার পশুর হাট বসছে এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের উর্ধমুখী প্রবণতার মধ্যে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা কেউই হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বাড়তি সতর্কতা সম্পর্কে এখনও কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেননি। গত ঈদে পঙ্গপালের মতো মানুষ বাড়িতে যাওয়া এবং আসার কারণে ঈদের পর বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যু নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। এরইমধ্যে আবার দুই সিটি কর্পোরেশন ঢাকায় অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট বসানোর পায়তারা করছে। যতই স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হোক না কেন, এত আক্রান্ত বাড়ার পর কেউ হাটে বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন প্রবণতা চোখে পড়ছে না। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কোরবানির পশুর হাট বসানো হলে তা দেশের করোনা পরিস্থতিকে আরও উস্কে দেবে। ফলে দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে আত্মঘাতী। মহামারী পরিস্থিতিতে এক বছর পশু কোরবানি না দিলে এমন কিছু হবে না। সৌদি আরব যদি হজ্জের মতো একটি অনুষ্ঠান বিদেশীদের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে পশু কোরবানি এক বছর বন্ধ থাকালে অযৌক্তিক কিছু হবে না। যদিও ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম লকডাউনে থাকা ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কোরবানির পশুর হাট বসবে।’ কিন্তু সেগুলো কি মুখে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি আরও বাড়তি সতর্কতা থাকবে সেটি নিয়ে এখনও কোন পরিকল্পনা নেই। আরও বিস্তারিত যেমন, ভিড় কীভাবে সামলানো হবে, ক্রেতা-বিক্রেতা, ইজারাদারদের কর্মী মিলে কতজনকে একসঙ্গে হাটে ঢুকতে দেয়া হবে, ঢোকা ও বের হওয়ার আলাদা পথ হবে কিনা, তাপমাত্রা পরিমাপ করা, দূর দূরান্ত থেকে হাটে পশু বিক্রি করার জন্য যারা আসবেন তারা কীভাবে আসবেন, তাদের থাকার জায়গাগুলো কেমন হবে, রাস্তার হাটগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে এসব নিয়ে সিটি কর্পোরেশন বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্তৃপক্ষ কেউই পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেননি। এক পরিবার থেকে ক’জন আসতে পারবেন, যারা বাড়ি বাড়ি গরু পৌঁছে দেন, তারা তা করতে পারবেন কিনা, গরু জবাই করার যেসব সামগ্রী হাটে বিক্রি হয় এবার সেগুলো বসতে দেয়া হবে কিনা সেগুলোও ভাবা হয়নি। তবে মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি বলছেন, আমরা কোনদিন চিন্তাও করিনি যে মুখে সারাক্ষণ মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ইজারাদার, বিক্রেতা, ক্রেতা এদের আমরা কীভাবে মেইনটেইন করব তার একটি গাইডলাইন দিতে হবে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। কোন কিছুই এখনও পরিকল্পনা করা হয়নি। তিনি বলছেন, ক্রেতা, বিক্রেতা, ইজারাদার সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে যে কোরবানির হাট যখন বসছে তখন একটা চরম মহামারীর মধ্যে আমরা আছি। ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শরীফ আহমেদ বলছেন, ঢাকা শহরে বেশিরভাগ হাট বসে রাস্তার ওপরে। এই জায়গাগুলো এমনই যেখানে পেরিমিটার দেয়া খুব মুশকিল। তিনি বলছেন, আমরা কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি। ক্রেতা বিক্রেতার দূরত্ব রাখা, অসুস্থ ব্যক্তি যাতে হাটে না আসে, এ রকম বেশকিছু পয়েন্ট আমরা নোটডাউন করেছি, যেগুলো মাইকে বলা হবে। আমরা ভিড় সামলাতে পুলিশের সাহায্য নেব। আমরা এ রকম প্রাথমিক কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, কোরবানির পশুর হাট পরিচালনায় এবার ইজারার বরাদ্দপত্রে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সব ধরনের নির্দেশনা দেয়া হবে। তিনি বলেন, ‘হাট পরিচালনা বা এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা ভঙ্গ করলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।’ গত ২৫ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে পশুর হাট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়ে মেয়র তাপস এ মন্তব্য করেন। ডিএসসিসি’র মেয়র এ সময় স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে এবার গরুর হাটে যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দিয়েছি। যে কয়েকদিন হাট চলবে, কমিটি সার্বক্ষণিকভাবে সেসব হাট তদারকি করবে, যাতে করে মহামারী করোনা বিস্তৃতি লাভ করতে না পারে। এছাড়াও, স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।’ মেয়র তাপস আরও বলেন, ‘অস্থায়ী এসব গরুর হাট তিন থেকে পাঁচদিনের জন্য অনুমোদন দেয়া হবে। হাটগুলোতে একটি গরুর অবস্থান থেকে আরেকটি গরু কতটুকু দূরত্বে রাখা যাবে, সেটাও আমরা চিহ্নিত করে দেব। এছাড়া হাটগুলোতে একমুখী চলাচল নিশ্চিত করতে নির্দেশনা প্রদান করা হবে।’ যতই স্বাস্থ্যবিধির দোহাই দেয়া হোক না কেন, বাস্তবে কোরবানির পশুর হাটে এসব নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছে। বৃহস্পতিবার বগুড়ার একটি কোরবানির পশুর হাটে দেখা গেছে, ক্রেতা-বিক্রেতাদের ঢল। স্বাস্থ্যবিধি দূরের কথা, কোন ক্রেতা বা বিক্রেতার মুখে মাস্ক নেই। মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে হাটে ঘুরছে, গরু দেখছে এবং কেনাবেচা করছে। ইজারাদাররা বলছে, ‘কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি।’ ফলে কারা তরফ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর কোন উদ্যোগ নেই। আর এত বড় হাটে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোও অসম্ভব ব্যাপারে। হাট চালু হয়ে গেলে কোনভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানানোর কোন উপায় থাকবে না। ফলে কোরবানির ঈদের পরও দেখা যাবে, করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেছে। তখন তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? মহামারীর সময়ে গরুর হাট আয়োজনের কারণে যদি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায় তখন কী তার দায়-দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশন গ্রহণ করবে ? স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রমণ রোগ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পরিচালক ডাঃ শাহনিলা ফেরদৌস বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি তো একটা রয়েছে। অধিদফতর ইতোমধ্যেই সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংক্রমণ রোধে ৬২ পাতার একটি নির্দেশনা দিয়েছে। যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আলাদা করে বলে দেয়া আছে। যেমন স্কুল, মসজিদ, অফিস, কাঁচাবাজার, বিনোদন কেন্দ্র এগুলো সম্পর্কে আলাদা করে। তবে পশুর হাট যেহেতু খোলা জায়গায় অস্থায়ী একটি ব্যবস্থা, সেটার জন্য আমরা আলাদা করে চিন্তা করে একটা পরিকল্পনা করব। কিন্তু এটুকু হলেই কী হবে? আর একটু অগ্রসর চিন্তা কেন করা সম্ভব হচ্ছে না? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার প্রতি ক্ষেত্রে সমন্বয়ের মারাত্মক অভাব দেখা গেছে। তার ভাষায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো তালগোল পাকিয়ে ফেলার নমুনা দেখা গেছে। এর কয়েকটি উদাহরণ দেখা গেছে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, পোশাক কারখানা ও ঈদের কেনাকাটায় শপিংমল খুলে দেয়ার সময়, রেডজোন ও এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করার ক্ষেত্রে। ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোপূর্বে যে কার্যক্রমগুলো গৃহীত হয়েছে, তার কোনটাই আমরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা দেখেছি সর্বশেষ ঈদের ছুটিতে জনগণের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কীভাবে বেড়েছে। তার মতে, বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলা করার আর কোন সুযোগ নেই। যদি এবার পশুর হাট বসতে অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হবে। এই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে প্রয়াসগুলো আমরা নিচ্ছি তার সবটাই ব্যর্থ হবে। অন্তত এবার সরকার রাশ টেনে ধরুক। তিনি বিকল্প কিছু চিন্তা করার কথা বলছেন। অনলাইন ও মোবাইল এ্যাপে পশু বিক্রি উৎসাহিত করা এবং এবার যেভাবে রাজশাহী থেকে বিশেষ ট্রেনে সরকার আম ঢাকায় নিয়ে এসেছে, ফসল কাটার সময় শ্রমিকদের স্থানান্তর করেছে ঠিক সে রকম কিছু উদ্যোগ নেয়া দরকার।
×