ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপন বিশ্বাস

সাহিত্য সম্রাট ॥ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০১:১৬, ২৬ জুন ২০২০

সাহিত্য সম্রাট ॥ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের সাহিত্য সম্রাট।বাংলা সাহিত্যের বিরান ভূমিতে তিনি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনকার দিনে আমরা যার নাম শুনলেই বঙ্কিম দৃষ্টিতে অর্থাৎ একটু বাঁকা চোখে তাকাই। আজ থেকে ১৮২ বছর আগে ১৯৩৮ সালের ২৭ জুন তার জন্ম পশ্চিম বাঙলার নৈহাটিতে। এখন তাকে ঘিরে হয়তো কোন জন্ম জয়ন্তীর অনুষ্ঠান হবে না। কিছু দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার সাপ্তাহিক আয়োজনে দু’একটা লেখা প্রকাশ হবে।সেই লেখা পড়তে পড়তে কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে বুক সেল্ফের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। সেল্ফে বই আছে কিন্তু পড়া হয়নি। পড়ব পড়ব করেও পড়া হয়ে ওঠেনি। না, বঙ্কিমচন্দ্র আমাদেরকে পড়তেই হবে এমন কোন দিব্যি কেউ দেয়নি। না পড়লে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখালেখি নিয়ে আমাদের কিছু প্রচলিত ধারণা আছে। বঙ্কিমের লেখার ভাষা দূর্বোধ্য, বঙ্কিম সাম্প্রদায়িক, বঙ্কিম ইংরেজ সরকারের সেবাদাস ছিলেন। এসব বিষয় জানার জন্যই বঙ্কিমের লেখা পড়া দরকার। সেই দরকারী কাজটা আমাদের হয়ে ওঠে না। শুধু আমাদের কেন, এমন গল্পও প্রচলিত আছে যে, যিনি বঙ্কিমের বই সম্পাদনা করেছেন তারও নাকি সব লেখা পড়া হয়নি। তবে একটা সময় ছিল যখন বঙ্কিম সাহিত্য পড়া হতো। রবীন্দ্রনাথ নিজে পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চরিত্ররা পড়ত। বঙ্কিমের সময়কালেই রবিঠাকুরের আগমন ঘটেছে। তখন বঙ্কিম একুশ বছরের সদ্য যুবক আর বঙ্কিম যখন গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ বত্রিশ বছরের সৌম যুবক। উনিশ শতকের ষাট-সত্তরের দশকে যখন বঙ্কিমের উপন্যাসগুলো প্রকাশ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তখন নিতান্তই বালক। তবে ছোটবেলা থেকেই বালক রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন পত্রিকা পড়তেন। বঙ্কিম ব্রিটিশ সকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের চাকরি করতেন। তার লেখায় ইংরেজ প্রীতির অনেক নজির খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে একথাও তো আমাদের স্বীকার করতে হবে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র বন্দেমাতরম’র স্রষ্টাও বঙ্কিমচন্দ্র। এই বন্দেমাতরম খ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠের জন্য তাকে অনেক মাশুলও দিতে হয়েছে। এখন আমরা তার এই বন্দেমাতরম’র ভেতরেও সাম্প্রদায়িক গন্ধ খুঁজি। যে ভাবে আমাদের দেশে একটি মহল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ এবং আমাদের জাতীয় সংগীতকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করে। যেকোন লেখকের লেখার মূল্যায়ন করার জন্য তার সময়টি একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। লেখক তার লেখার মাধ্যমে সময়েরই প্রতিনিধিত্ব করেন। বঙ্কিমের উপন্যাসের চরিত্রদের মুখে সময়ের নিরিখে নানা রকমের মতামত প্রকাশ পেয়েছে। আমরা অনেক সময় চরিত্রের সংলাপের একটি খন্ডিত অংশ নিয়ে লেখককে তকমা লাগিয়ে দেই। তখন লেখকের অন্য মতগুলো আমাদের নজরে আসে না। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনী লেখক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘আনন্দমঠের সন্ন্যাসীরা মুসলমান রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে আমরা বলি বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন, বঙ্কিম যখন উপন্যাসের শেষে মহাপুরুষের মুখ দিয়ে হিন্দু ধর্মের সুতীব্র সমালোচনা করে হিন্দু সন্তানদলের হাত থেকে রাজ্যশাসনের অধিকার কেড়ে নেন তখন আমরা তাঁকে কি বলব?” বঙ্কিমের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’। এই উপন্যাসে ফকির চাঁদশাহ সীতারামের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘বাবা! শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে।’ ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের উপসংহারে ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’-এ বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন, ‘কোন পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু মুসলমানের কোন প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হইলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভাল হয় না। ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে আছে। বরং ইহাতে স্বীকার করিতে হয় যে, যখন মুসলমান এত শতাব্দী ভারতবর্ষের প্রভু ছিল, তখন রাজকীয় গুণে মুসলমান সমসাময়িক হিন্দুদিগের অপেক্ষা অবশ্য শ্রেষ্ঠ ছিল। কিন্তু ইহাও সত্য নহে যে, সকল মুসলমান রাজা সকল হিন্দু রাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অনেক স্থলে মুসলমানরাই হিন্দুর অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ।” বাঁকা চোখে এই বঙ্কিম আমাদের অদেখাই থেকে যায়। এই বঙ্কিমকে আমরা আবিস্কার করতে পারি না। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৭৯ সনে ছাপা হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র একই সঙ্গে হাসিম শেখ এবং রামা কৈর্বত্ত, অর্থাৎ বাংলার মুসলমান এবং হিন্দু প্রজা, কি দুর্দশার জীবন যাপন করছে, তার বর্ণনা করার সময় তিনি হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ তো করেনইনি, বরং তিনি বলেছেন, “দুই চারিজন অতি ধনবান ব্যক্তির পরিবর্তে’ ‘ছয় কোটি সুখী প্রজা’ দেশের মঙ্গল এবং শ্রীবৃদ্ধিকে সূচিত করবে। এবং এই ছয় কোটি প্রজার মধ্যে তিন কোটি হাসিম শেখ আর তিন কোটি রামা কৈর্বত্ত।” রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাহিত্যের অনেকটা পথ হাতে ধরে এগিয়ে দিয়ে গেছেন। গদ্য রচনার ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করেছেন। সূচনা করেছেন আধুনিক বংলা উপন্যাস লেখার। বাংলা ভাষার গদ্যরীতি সেইসময় রামমোহন-বিদ্যাসাগরের হাত ধরে সবেমাত্র শৈশব উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করছে। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন দীর্ঘ নয়। এ সময়ের মধ্যে তার সাহিত্য সাধনা বিস্ময়কর। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। ১৫ বছর বয়সে তিনি দুটি ছোট কাব্য রচনা করেন। প্রথম গদ্যরচনা ছিল ইংরেজি ভাষায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ইংরেজি উপন্যাস ‘রাজমোহন’স ওয়াইফ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৮ সালে কিশোরীচাঁদ মিত্রের সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায়। বঙ্কিমচন্দ্র তার সাহিত্যিক জীবনের বাইশ বৎসরে চৌদ্দটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। সেগুলোর নাম : দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৯৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৭৫), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮১), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম (১৮৮৭)। এই উপন্যাস ছাড়াও তার আছে ‘কমলাকান্তের দফতর’, ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’, ‘লোকরহস্য’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ এবং আরও কিছু গদ্য রচনা। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ করেন বঙ্গদর্শন নামের সাময়িক পত্রিকা। বঙ্গদর্শন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি এবং সাহিত্য সমালোচনা উভয়ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কর্মক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিলেও তাঁর স্বদেশানুরাগ ও জাতীয়তাবোধ ব্রিটিশ শাসককে সাবধানি করে তুলেছিল। দীর্ঘ ৩৩ বছরের কর্মজীবনে এজন্যই বঙ্কিম কখনও পদোন্নতির সৌভাগ্য লাভ করেননি। গভীর হতাশায় শেষপর্যন্ত ১৮৯১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরস্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন। এরপরই দ্রুত স্বাস্থ্যহানি ঘটে । অবশেষে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে বহুমূত্র রোগে ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়। । রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের অবদানের স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, ‘ বঙ্গদর্শন ও বঙ্কিমের রচনায় বাংলা সাহিত্য প্রথম আধুনিক যুগের আদর্শকে প্রকাশ করেছে।’ বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। স্বপন বিশ্বাসঃ কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্মঃ ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪। কৃষিবিষয়ে স্নাতক ও ব্যবসাব্যাবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শুল্ক বিভাগে কৃষিবিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্মরত। প্রকাশিতগ্রন্থ- একটি।
×