ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিলারা মেসবাহ

কামাল লোহানী ॥ মৃত্তিকাসুবাসিত এক ক্ষণজন্মা

প্রকাশিত: ০১:০৯, ২৬ জুন ২০২০

কামাল লোহানী ॥ মৃত্তিকাসুবাসিত এক ক্ষণজন্মা

মননে ও বাহ্যিক সৌন্দর্যে আপাদমস্তক শ্বেতশুভ্র এক মানুষ কামাল লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খান সনতলা নামের শ্যামল গ্রামে তাঁর জন্ম। মাকে হারান শৈশবে। নিকটাত্মীয় আম্বিয়া খান লোহানী, যাঁর জন্ম ১৮৫২য় সিরাজগঞ্জের আমলা পাড়ায়। তাঁর পিতা ছিলেন খ্যাতিমান আইনজীবী। আম্বিয়া লোহানী আলীগড়ে পড়াশোনা শেষে লন্ডন যান। ফ্রান্স, জার্মান, সুইজারল্যান্ড অবস্থান করে শেষে মস্কোতে যান এবং রুশ বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে বামপন্থী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাংবাদিক ও শিক্ষকতা ছিল তাঁর পবিত্র নেশা। ইংরেজী, ফরাসি, জার্মান, হিন্দী, ফার্সি, রুশ ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল। বহু প্রবন্ধ নিবন্ধপত্র পত্রপত্রিকায় নিরলস লিখেছে। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর আম্বিয়া খান লোহানী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লুহানীর বুদ্ধি ছিল তরবারীর মতো ধারালো। পড়াশোনা ছিল যথেষ্ট।’ লড়াকু এই অসাধারণ গুণী মানুষটি মহামতী লেনিনের মৃত্যুর পর বর্বর স্ট্যালিনের হুকুমে মৃত্যুবরণ করেন। ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে তাঁর মহৎ হৃদয়ের পাঁজর ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। তিনি ফতেহ লোহানী ভাইয়ের আপন মামা। চাচা আবু লোহানী কলকাতায় সাংবাদিক, লেখক হিসেবে সুপরিচিত। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির’ সহ- সম্পাদক ছিলেন ১৯১৭-১৮ সালে। ৩৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আমাদের চাচা। দৈনিক সুলতানের সম্পাদক নিযুক্ত হন মৃত্যুর কিছুদিন আগে। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাজমহল, শপথ ইত্যাদি। তাঁর সন্তান ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী, হুসনা বানু খানম। চাচা মুসা লোহানীর পুত্র লড়াকু নেতা কামাল লোহানী। শৈশবে কলকাতার শিশু বিদ্যাপিঠে তাঁর পড়াশোনার হাতে খড়ি। দেশভাগের পর তিনি পাবনা চলে আসেন। পাবনা জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়েন। এরই মধ্যে বামধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন। ছোট চাচা তাসাদ্দুক লোহানী শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যক। তাঁর কড়া অভিভাকত্বে, নজরদারিতে ‘ব্যাহত’ হচ্ছিল তাঁর আরাধ্য সাধনা। রাত গভীরে বাড়ি ফেরা, জেলহাজত ইত্যাদি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমার বাবা তাসাদ্দুক লোহানী অত্যন্ত উদ্বেগে বিমর্ষ। এভাবে দুলাল (ডাক নাম) যদি রাজনৈতিক আন্দোলনে মেতে থাকে তো পড়াশোনা চুলোয় যাবে! এক ‘শুভক্ষণে’ তরুণ কামাল লোহানী ছোট চাচার কাছে প্রস্তাব রাখলেন। তিনি ঢাকা যাবেন। চাচা ১৫/- টাকা দিলেন। ঢাকা এসে চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা হলো। আরও আত্মীয় ছিলেন তৌফিক আজিজ খান ও অন্যান্যরা। দৈনিক মিল্লাতে ৮০ টাকা বেতনে সাব-এডিটর হিসেবে নিযুক্ত হলেন। মানুষের খুঁটিনাটি সুখ দুঃখ জানা, অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যাঁর জীবনের আজন্ম ব্রত তাঁর মুখস্থ পাঠ উগড়ে দিয়ে নিরেট প-িত হওয়া সাজে না! দেশ, আমজনতার কল্যাণের দাবিতে তাঁর হৃদয়ে মর্মভেদী বেদনার জখম ছিল। দূরারোগ্য এই বেদনার উপশমের আশায় কত কিনা করেছেন। নেতার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের দীপ্তি জনমানুষকে ভীষণভাবে আলোড়িত করতো। তাঁর অনুগামীরা নিমেষে অনুপ্রাণিত হতো। কামাল লোহানী ভাই দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা বহু পত্রিকায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। নাওয়া-খাওয়া ঘুম বিশ্রাম ছিলো অনিয়মিত। তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সুবক্তা, বাচিকশিল্পী, ধারাভাষ্যকার, অভিনেতা, সংগঠক এমনকি নৃত্যশিল্পীও ছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। কামাল লোহানীর অন্তর জুড়ে বাজতো গণসঙ্গীতের অনুরণন। তিনি জীবনের অনেকটা অমূল্য সময় দিয়েছেন গণশিল্পী সংস্থা ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কর্মকা-ে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত হন। ছায়ানটে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। গণজাগরণ ও বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সবসময় আপোসহীন ও কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মার্ক্সবাদী ভাবাদর্শে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কামাল লোহানীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর জবানে শুনেছি তিনি ওখানে জুতা সেলাই থেকে চ-িপাঠ করেছেন। প্রয়োজনে ঘর ঝাড়ু দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতারের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। দুই দফায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে যোগ দেবার কথা ছিল কামাল লোহানীর। সরকারী নির্দেশ তাঁকে ইংলিশ স্যুট পরতে হবে। ঐ লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি চলবে না। তিনিও নাছোড়বান্দা। ফলে সফর বাতিল। একই সালে তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের আন্তর্জাতিক ফিচার সার্ভিস ডেপথ্ নিউজের সম্পাদক নিযুক্ত হন। কামাল লোহানী জি.এ মান্নানের কাছে নৃত্যেরও তামিল নেন। এক সময় জি.এ মান্নানের নেতৃত্বে ‘নক্সি কাঁথার মাঠ’ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নৃত্য পরিবেশন করে প্রভূত প্রশংসা পান। শ্যামা নৃত্যনাট্য পরিবেশনা করেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। বজ্রসেনের ভূমিকায় ছিলেন তিনি, বিপরীতে নৃত্যশিল্পী ছিলেন মন্দিরা নন্দী। তিনি অভিনয়ও করেছেন। এইসব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ পরিচয় তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’ ‘সংস্কৃতি ভাবনা’ ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম। তাঁর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সে সময় ‘কামাল লোহানী সময়ের সাহস’ সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। দেশবরেণ্য গুণীজনের স্মৃতিকথা এতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার আকর গ্রন্থ। কামাল লোহানীর জীবনের বিভিন্ন কর্মধারার স্বচ্ছ বিবরণ এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। মাটির নির্জলা সোঁদা গন্ধ আর সহজ সরল পীড়িত জনমানুষের জন্য ছিল তাঁর মমতা। শিরদাঁড়া সোজা রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র। সহনশীল লড়াকু মানুষ। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে বাংলার দুর্যোগকালীন প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে ঋজু সুদৃঢ় মুষ্ঠিবদ্ধ হাত গর্জে উঠেছে, আপোসহীন। তাঁর চিত্তে দরদি বৈভবে, হাজার মানুষের ভালোবাসায় তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। যদিও আর দশজনের মতো বিত্ত বৈভব তাঁর ছিল না। কামাল ভাই যে শুধু নিজের কর্মকা- নিয়ে সদাব্যস্ত থাকতেন তা নয়। আমার ভাই সাদ লোহানীর শৈশবে কঠিন নিউমোনিয়া হয়েছিল। ভাই সবসময় আমার মাকে সান্ত¡না দিয়েছেন। ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। ’৭১ এ ছোট ভাইটি ঢাকা মেডিক্যাল হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। অগ্রজ রোজ বীবুকে দেখতে যেতেন। নানা বিষয়ে মাকে সহযোগিতা করতেন। এমন হৃদয়বান মানুষ অন্যের দুঃখে হন্যে হয়ে ছুটে যেতেন। এখন শুনি অনেকে বলেন, আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আদতে তিনি সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতেন। ভাবী শিক্ষিকা দীপ্তি লোহানী বেঁচে থাকতে বাড়িতে ঘন ঘন খাবারের দাওয়াত থাকতো। মিলন মেলায় অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। আনন্দময় সময় কাটতো। কামাল ভাই ভালো খাবার পছন্দ করতেন, কিন্তু খেতেন সামান্য। শেষ বয়সে এই দীর্ঘকায় নির্মেদ মানুষটি নানা রোগে ভুগছিলেন। তিন সন্তান সাগর, বন্যা, উর্মি তাকে আগলে রেখেছিল। যেভাবে তিন বছর শয্যাশায়ী স্ত্রীকে শুশ্রুষা করেছেন তিনি। স্বামী স্ত্রীকে শুশ্রুষা করেন, এই চিত্র বাংলাদেশে বিরল। চোখে গ্লোকুমার কারণে কিছুই দেখতে পেতেন না। কামাল লোহানীরা জাতির মশাল। যাবতীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে তিনি আলোর অভয়বাণী নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে যেতেন। নিজের ভাল মন্দ বিচার্য বিষয় নয় যেন। এঁদের মতো মানুষের শূন্যস্থান সহজে পূরন হওয়ার নয়।
×