ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ক্রোধ সংযম বড় বীরত্ব

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২৬ জুন ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ক্রোধ সংযম বড় বীরত্ব

মানুষের অভ্যন্তরে গুণধারক ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি দুর্বলচিত্ত সঞ্চারক তন্ত্রীও রয়েছে। এসবের উৎপত্তি স্থল নফস। মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক যে সমস্ত রিপু অর্থাৎ শত্রু রয়েছে সাধারণত তার সংখ্যা ছয়টি। এই ষড়রিপুর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রোধ বা রাগ। রাগকে কোপ, রোষ ইত্যাদিও বলা হয়। কোপ যখন প্রচ-ভাবে প্রকাশ পায় তখন তা কোপানলে পরিণত হয়। ক্রোধ মানুষের মেজাজে বা মানস তন্ত্রীতে দাবানলের আদলে প্রজ্বলিত অগ্নির মতো দাউ দাউ করে জেগে উঠলে সেই ক্ষণে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং দিশেহারা হয়ে এমন অঘটন ঘটায় যা আদৌ কাম্য নয়। মূলত মানুষের প্রকাশ্য দুশমন হচ্ছে শয়তান। এই শয়তান মানুষের নফসকে সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রণে আনার অপচেষ্টায় তৎপর রয়েছে। দুর্বল চিত্তের মানুষের নফসকে শয়তান রিপু দ্বারা এমনভাবে সংক্রমিত করে যে, রিপু যখন যে নফসের ওপর প্ররোচিত হয় তখন সেই নফস তা সংবরণ বা সংযমন করতে পারে না। ক্রোধ মাত্রাতিরিক্তভাবে জেগে উঠলে তখন বিবেক বলতে কিছু থাকে না বিবেক তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মাত্রাতিরিক্ত রাগ বা ক্রোধ তাৎক্ষণিকভাবে বিবেককে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ক্রোধের কারণে উদ্ভূত বিবেকহীনতার ফলাফল মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যা অশান্তি, অরাজকতা ও চরম উগ্রতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কথায় আছে ক্ষণে তুষ্ট, ক্ষণে রুষ্ট, রুষ্ট-তুষ্ট ক্ষণে ক্ষণে। এ ধরনের মানুষ স্থিরমতিসম্পন্ন হতে পারে না। কেউ কেউ হয়ত রাগ আর অভিমানের মধ্যে মিল খুঁজতে লেগে যাবেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, অভিমানের উদ্রেক সাধারণত হয় আপনজন, প্রিয়জন অথবা বন্ধুজনের উপেক্ষা, অনাদর, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, উদাসীনতা, অগ্রাহ্য, অবহেলা, অমনোযাগিতা কিংবা অস্বীকৃতির কারণে, আর এসব অবস্থায় ক্ষোভ বা মানসিক চাঞ্চল্য, মনস্তাপ, মনোবেদনা সঞ্চারিত হতে পারে। আর এই ক্ষোভ যখন চরম মাত্রায় উপনীত হয় তখন তা বিক্ষোভে পরিণত হয়ে যায়। অবস্থাভেদে এই বিক্ষোভ নানামাত্রিক হতে পারে, যেমন : প্রবৃত্তির বিক্ষোভ, চিত্ত বিক্ষোভ ইত্যাদি। ক্রোধের আরবী হচ্ছে গাদাব, উচ্চারণভেদে ফারসীর প্রভাবে গাদাব উচ্চারিত হয় গজব রূপে। গাদাব বা ক্রোধ যে কত ক্ষতিকর ও মারাত্মক সে সম্পর্কে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ইন্নাল গাদাবা লাইউসিদুল ইমানা কামা ইউসিদুস সবিরু আল আসালা-নিশ্চয়ই ক্রোধ ইমানকে বিনষ্ট করে যেমন সবির মধুকে বিনষ্ট করে দেয়। (বায়হাকী)। সবির হচ্ছে এক জাতীয় তিক্ত ফল অনেকটা মাকালের মতো, একে হিন্দীতে ঈলু বলে। ক্রোধ ইমানকে নষ্ট করে দেয়Ñ এই উক্তির মধ্যে এটা যে কত নিকৃষ্ট তা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। ক্রোধাবিষ্ট হয়ে মানুষ এমন কিছু করে ফেলে যা অনেক ক্ষেত্রে তার ইমান-আকিদা বরবাদ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে যায়। মার্জিত, পরিশীলিত মানুষের মধ্যে ক্রোধের ভয়াবহতা থাকতে পারে না। একবার এক মল্লযুদ্ধে. হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু শত্রুকে কুপোকাত করে ফেললে শত্রু তার মুখে থুথু দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আসাদুল্লাহিল গালিব হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু ক্রোধের বশবর্তী হওয়া সত্ত্বেও শত্রুকে ছেড়ে দেন এই ভেবে যে, শত্রুর থুথু তাকে রাগান্বিত করেছে, অতএব এখন শত্রুকে আঘাত হানার অর্থ হবে ব্যক্তিগত আক্রোশে তিনি শত্রু নিধন করছেন। কুরআন মজীদে যে কোন উত্তেজনাকর পরিস্থিতে মেজাজ শান্ত রেখে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং সাবধানতা অবলম্বন কর, তাহলে অবশ্যই সেটা হবে দৃঢ় সঙ্কল্পের কাজ। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত-১৮৬)। উল্লেখ্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অশুভ, অকল্যাণ, অসত্য ও অশালীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, অপকর্ম, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন প্রভৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, পারিবারিক কিংবা সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবাধ্যতা দূর করার জন্য সুসংগঠিত ও সুসংহত ব্যবস্থা গ্রহণ করা কিন্তু সরাসরি ক্রোধের আওতায় পড়ে না। সে ক্রোধ রোষানলের ভয়াবহতায় পরিণত হয় না, বরং তা হয় সংস্কারের পন্থা। ক্রোধের ভাল-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে, তবে সংস্কারের জন্য যে ক্রোধ সেটা মানুষকে বা সমাজকে ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করার হাতিয়ার। সে ক্রোধ গজব অর্থের আওতায় পড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিপুর অন্তর্গত ক্রোধ অকল্যাণকর ও অশুভ। ইংরেজীতে একটা কথা আছে : ইৎড়শবহ ভধসরষু রং ঃযব ৎড়ড়ঃ ড়ভ লাঁবহরষব ফবষরহয়ঁবহপু- ভাঙ্গা পরিবারই হচ্ছে অপরিণত বয়সে দোষপ্রবণতার ভিত্তি। ভাঙ্গা পরিবারের সংজ্ঞা বহুবিধ। আমরা জানি সংসারের মাইক্রোস্তর বা অনুপর্যায় হচ্ছে বাপ-মা ও সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে গঠিত যে পরিবার। যে পরিবারে বাপ-মায়ের মধ্যে রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে সে পরিবারের সন্তান-সন্ততির অন্তরে এক ধরনের অশান্তি সঞ্চারিত হয় যা তাদের এক দুর্দান্ত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এই ধরনের পরিবারের অর্থবৈভব যতই থাকুক না কেন তা বাপ-মায়ের মধ্যে রাগারাগির কারণে কোনরূপ সুখের পরিবেশ আনতে পারে না। দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাপ-মায়ের মধ্যকার অশান্তি পারিবারিক ক্ষেত্রে এমন ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে যা নিরসন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। কথায় আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এ কথাটা যেমন সঠিক তেমনি এ কথাটাও সত্য, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্কই পারে প্রকৃত সুখের পরিবার গড়তে। যে পরিবারের বাপ-মায়ের মধ্যে বচসা লেগেই থাকে সে পরিবারের ভিত এমন নড়বড়ে হয়ে যায় যে, দিনকে দিন সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা অপরিণত বয়সেই দোষপ্রবণতার শিকার হয়। তাদের বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই তারা দুর্দান্ত হয়ে ওঠে এবং অপরাধচক্রের খপ্পরে পড়ে। একপর্যায়ে তারা বড় বড় অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে, তারা সমাজ জীবনের জঞ্জালে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র উভয় ধরনের পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে কারণ রাগ বা ক্রোধ। ধনিক বা মধ্যবিত্তদের ছেলেমেয়েরা অপরাধ-পথে প্রধানত পা বাড়ায় পারিবারিক অশান্তি থেকে আর নি¤œবিত্ত বা সর্বহারা পরিবারের ছেলেমেয়েরা এ পথে আসে ক্ষুধা-দারিদ্রের সঙ্গে রাগের কারণে। কুরআন মজিদে মুত্তাকীদের গুণাবলী ও পরিচয় তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে : যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় (দান) করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৩৪)। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের অনুপম আদর্শ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : লাকাদ কানা লাকুম ফী রসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা- তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে সুন্দর সুন্দর আদর্শ। (সূরা আহযাব : আয়াত ২১)। আমরা প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যে, তিনি সর্বাবস্থায় মুচকি হাসির অধিকারী ছিলেন। তাঁর চেহারা মুবারকে হাসির ঔজ্জ্বল্য এমনভাবে চমকাত যে, সবাই তাঁর সান্নিধ্যে এসে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেত। যাঁরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাহাবী হচ্ছেন হযরত আনাস রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি বলেছেন : আমি দশ বছরকাল হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খেদমতে ছিলাম, তিনি কখনও আমার প্রতি উফ (বিরক্ত, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, ক্রোধ ঘৃণাসূচক কথা) উচ্চারণ করেননি। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ইন্নাল গাদাবা মিনাশ শায়তানি ওয়া ইন্না শায়তানা খুলিকা মিনাননারিÑ ওয়া ইন্নামা ইউতফাউন্নারু বিল মা-ই ফা ইযা গাদিবা আহাদুকুম ফালইয়াতাওয়াদ্দা-নিশ্চয়ই ক্রোধ শয়তান থেকে এবং শয়তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দ্বারা আর আগুন নির্বাপিত হয় পানির দ্বারা। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ রাগান্বিত হলে সে যেন তখনই অজু করে। (আবু দাউদ শরীফ)। এই হাদিসখানা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কারও মধ্যে রাগের উদ্রেক হলে সে যদি সঙ্গে সঙ্গে অজু করে তা হলে তার রাগ প্রশমিত হয়ে যাবে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু যার গিফারী রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের মধ্যে কেউ যখন দাঁড়ানো অবস্থায় রেগে যায় সে যেন তখনই বসে পড়ে। তাতেও যদি তার রাগ প্রশমিত না হয় তা হলে সে যেন শুয়ে পড়ে (তিরমিযী শরীফ)। এতে এটাই স্পষ্ট হয়ে যায় রাগের উদ্রেক হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করলে রাগ পড়ে যায়। হাদিস শরীফে আছে যে, যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বার হিফাজত করে তার দোষত্রুটি আল্লাহ তায়ালা গোপন রাখেন, আর যে ব্যক্তি রাগকে সংবরণ করে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার নিকট থেকে আযাবকে দূরে রাখেন, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট গোনাহর জন্য ক্ষমা চায় আল্লাহ্ তায়ালা তার গোনাহ্ ক্ষমা করে দেন। (মিশকাত শরীফ)। হাদিস শরীফে এও আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রাদি.) রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে আল্লাহর রসূল! এমন কি কাজ আছে যা আল্লাহ্ তায়ালার গজব থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে? হযরত রসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তুমি রাগ কর না। (মিশকাত শরীফ।) হযরত আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কুস্তি করাতে বীরত্ব নিহিত নেই, প্রকৃত বীরত্ব নিহিত রয়েছে ক্রোধ সংযমনে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। ক্রোধ না থাকাটা ভীরুতার লক্ষণ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধও আত্মআস্ফালনের শামিল। এই দুই অবস্থার মধ্যবর্তী হচ্ছে বিনয়। আত্মসংযম বিনয়কে প্রস্ফুটিত করে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×