ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে প্রয়োজন ১৩ লাখ ব্যাগ রক্ত ৪০ ভাগ ঘাটতির কারণে বছরে মারা যায় ৫৫ হাজার মানুষ রক্ত দেয়ার আহ্বান কোয়ান্টামের

করোনায় রক্ত সংগ্রহ কমেছে ৩২ ভাগ, ঝুঁকিতে অনেক রোগী

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৬ জুন ২০২০

করোনায় রক্ত সংগ্রহ কমেছে ৩২ ভাগ, ঝুঁকিতে অনেক রোগী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, দেশে বছরে রক্ত লাগে প্রায় চার লাখ ব্যাগ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ব্যাগে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে নয় লাখ ব্যাগ বেশি রক্তের প্রয়োজন হয়। এই হিসেবে ২০২০ সালে প্রয়োজন প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগের বেশি রক্ত। এক দশকেরও কম সময়ে দেখা গেছে রক্তের চাহিদা বেড়েছে ৩ গুণের বেশি। রক্ত সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম বলছে, করোনাকালে প্রতিমাসে রক্ত সরবরাহ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। সরবরাহ কম থাকায় জরুরী রোগীদের রক্ত দেয়া যাচ্ছে না। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী এক বছরে সাড়ে আট হাজার ইউনিটের মধ্যে অর্ধেক কমে রক্ত সরবরাহ দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার হাজার ইউনিটে। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় সবাইকে রক্তদানে আহ্বান জানানো হয়েছে কোয়ান্টামের পক্ষ থেকে। এক হিসাবে দেখা গেছে দেশে সবচেয়ে বেশি রক্ত দানে আগ্রহী তরুণ সমাজ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাঁধন রক্ত দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সারাদেশে এখন পরিচিত। মূলত বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই সংগঠনের মাধ্যমে রক্ত দিয়ে থাকেন। এর বাইরে অন্য বিশ^বিদ্যালয়েও রক্ত দেয়ার জন্য তরুণ শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে ওঠেছে। এর বাইরে কোয়ান্টামসহ আরও কয়েকটি সংগঠন রক্ত দেয়ার কাজে নিয়োজিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে বছরে প্রায় ১১ কোটি ব্যাগ রক্ত স্বেচ্ছায় সংগৃহীত হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা জানান, চাহিদা পূরণের জন্য ২০২০ সালের মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সরকারীভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে, জনগণের মধ্যে উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে স্বেচ্ছায় রক্ত দেন ৪৫০ জন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাত্র তিনজন। নি¤œœ আয়ের দেশগুলোতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের রক্তের ৬৫ ভাগ কাজে লাগে অনুর্ধ পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের, আর উন্নত দেশগুলোতে সংগৃহীত রক্তের ৭৬ ভাগ যায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের শরীরে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচী থেকে জানা যায়, স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা গত ১০ বছরে বেড়েছে প্রায় ৩৫ ভাগ। থাইল্যান্ডে এই হার ১০০ এবং ভারতে ৬৫ শতাংশ। ২০০০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচী শুরু হয়। বর্তমানে দেশে সরকারী ৩৯০টি এবং লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারীভাবে ১০২টি ব্লাড ব্যাংক রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এসব কেন্দ্রে হেপাটাইটিস বি-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ঘাটতি ৪০ ভাগ রক্ত ॥ রক্তদাতাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী বলছে, বছরে মোট চাহিদার ৬০ ভাগ রক্ত পাওয়া যায়, ঘাটতি থাকে বাকি ৪০ ভাগ। দেশে প্রতিবছর ১৩ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদার মধ্যে রক্ত না পেয়ে মারা যান প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ। অন্য একটি গবেষণা বলছে, প্রয়োজনীয় রক্তের ৩৫-৪০ ভাগ পাওয়া যায় রোগীর নিকটজন থেকে, ১৫-২০ ভাগ স্বেচ্ছাসেবী থেকে ও ১৫-২০ ভাগ পেশাদার রক্ত বিক্রেতা থেকে। বাকি ২০-২৫ ভাগ বা প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থেকে যায়। অন্যদিকে পেশাদার বিক্রেতারা যে ১৫-২০ শতাংশ রক্তের যোগান দেন তা অনিরাপদ। ফলে ঘাটতি ও অনিরাপদ রক্তের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বা প্রায় ৫ লাখ। করোনায় এখন বৈশি^ক মহামারী চলছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবল দেশেও। যা অন্য দেশের মতো মহামারী আকারে ছড়াতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। বিশে^ সাড়ে ৯৪ লাখ ইতোমধ্যে আক্রান্ত আর মৃত্যু হয়েছে চার লাখ ৮২ হাজারে বেশি মানুষের। দেশে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজারের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬২১ জনে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে রক্ত দানের সংখ্যা কমেছে অনেক। কিন্তু রোগীর সংখ্যা তো কমেনি। তাই অনেকে রক্তের প্রয়োজনে ঘুরছেন হাসপাতাল, ব্ল্যাড ব্যাংক থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোতে। আট মার্চ করোনা রোগী দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত লকডাউন চলে। ৩১ মে থেকে সরকারী সাধারণ ছুটি বাতিলের পাশাপাশি চালু করা হয় গণপরিবহন। তবে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম ও কোয়ান্টাম ল্যাব কো-অর্ডিনেটর ডাঃ মনিরুজ্জামান বলেন, ২৬ মার্চ থেকে দেশের অনেক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেলেও কোয়ান্টাম ল্যাবের কর্মীরা মানবতার এই চরম মুহূর্তে ল্যাবের সব কার্যক্রম যথাসাধ্য চালু রেখেছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে তারা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গত এক মাসে (১৪ এপ্রিল-১৩ মে ২০২০) বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা রোগীদের কোয়ান্টাম ল্যাব সরবরাহ করেছে চার হাজার ৫৭৪ ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদান। যদিও গত বছর এই সময়ে (১৪ এপ্রিল-১৩ মে ২০১৯) সরবরাহ করা হয়েছিল আট হাজার ৫৮৫ ইউনিট। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিতে মাসিক সরবরাহ কমে গেছে চার হাজার ১১ ইউনিট। ফলে আমরা চার হাজারেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪৭ শতাংশ রোগী/রক্ত গ্রহীতাকে রক্ত বা রক্ত উপাদান সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের প্রাণ হলেন রক্তদাতারা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাদের উপস্থিতি কমে গেছে। ফলে গত এক মাসে ১৪ এপ্রিল-১৩ মে পর্যন্ত রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ তিন হাজার ১৩৫ ব্যাগ। যদিও গত বছর এই সময়ে (১৪ এপ্রিল-১৩ মে ২০১৯) চার হাজার ৫৮৯ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিতে মাসিক সংগ্রহ কমে গেছে এক হাজার ৪৫৪ ব্যাগ। এ হিসেবে রক্ত সংগ্রহ কমে গেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০০০ সালে শুরু করে দুই দশকের নিরলস প্রচেষ্টায় কোয়ান্টাম ল্যাব গড়ে তুলেছে তিন লক্ষাধিক রক্তদাতার একটি ডোনার পুল। এ পর্যন্ত কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম প্রায় ১২ লাখ রক্ত ও রক্ত উপাদান সরবরাহ করেছে। প্রতিমাসে বেশ কিছু থ্যালাসেমিয়া রোগী ও কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগীকে প্রসেসিং খরচ ছাড়াই কোয়ান্টাম ল্যাব থেকে রক্ত ও রক্ত উপাদান সরবরাহ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রক্তদাতারা যদি স্বেচ্ছায় রক্ত দান না করেন তাহলে অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগী, সন্তানসম্ভবা নারী কিংবা অপারেশনের রোগীকে প্রয়োজনের মুহূর্তে রক্ত সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। তাই স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের প্রতি এবং সব সুস্থ সবল প্রাপ্তবয়স্ক সচেতন নাগরিকদের প্রতি এই দুঃসময়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে হাজারও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ভূমিকা রাখর জন্য কোয়ান্টামের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
×