ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের বাজারে প্রতি ভরি ৭০ হাজার ছুঁইছুঁই

সোনার দামে রেকর্ড আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৬ জুন ২০২০

সোনার দামে রেকর্ড আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ

রহিম শেখ ॥ মহামারী করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। মূলত বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য এখন সোনা কিনে মজুদ করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক দিন ধরেই সোনার দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকায় বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই প্রতি আউন্স স্বর্ণ রেকর্ড এক হাজার ৭৬৮ ডলার ছাড়ায়। যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামনের দিনগুলোতে দাম আরও বাড়তে পারে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে সোনার দাম আউন্সপ্রতি দুই হাজার ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ায় এই প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের সোনার বাজারে। এ কারণে দেশে এখন প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এভাবে মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের নি¤œ ও মধ্যবিত্তরা এ ধাতব মুদ্রা কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর দেশী ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই দুর্মূল্যের মন্দা বাজারে সোনার ব্যবসায় আরও মন্দা দেখা দেবে। দেশের বেশির ভাগ ক্রেতা ব্যবহারের জন্য কেনে বিধায় মূল্যবৃদ্ধিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্রেতা কমার আশঙ্কা রয়েছে। বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি আউন্স এক হাজার ৭৪৩ ডলারে ওঠে। এতে বছরের ব্যবধানে দাম বাড়ে ২৩ শতাংশ। এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহের চার কার্যদিবসের প্রতি কার্যদিবসেই সোনার দাম বেড়েছে। সোমবার দাম বেড়ে এক হাজার ৭৬ ডলার স্পর্শ করে। মঙ্গলবারও দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে। বুধবার এশিয়া অঞ্চলের বাজারে লেনদেনের শুরুতেই প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়ে রেকর্ড এক হাজার ৭৭২ ডলারে উঠে যায়। বৃহস্পতিবার কিছুটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৬৮। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় আড়াই শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ বাড়ল সোনার দাম। জানা গেছে, গত বছরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল এক হাজার ৪৫৪ ডলার। এরপর করোনার কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সোনার দাম এক হাজার ৬৬০ ডলারে উঠে যায় এবং মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যায়। তখন প্রতি আউন্স এক হাজার ৪৬৯ ডলারে নেমে আসে। তবে মার্চে দরপতন হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম আবার বাড়তে বেশি সময় লাগেনি। দাম বাড়ার ধারাবাহিকতায় মে মাসে প্রতি আউন্স রেকর্ড এক হাজার ৭৪৮ ডলারে উঠে যায়। এর আগে ২০১২ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম এক হাজার ৭৭০ ডলারে উঠেছিল। এরপর গত আট বছরে এবারই প্রথম প্রতি আউন্স সোনার দাম এক হাজার ৭৭২ ডলার ছাড়িয়ে গেল। সোনার সম্ভাব্য বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস প্রকাশ করে থাকে গোল্ডম্যান স্যাকস। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বৈশ্বিক মন্দায় বিনিয়োগকারীরা সোনাকেই নিরাপদ মনে করছে। সংস্থাটি স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ তিন মেয়াদে সোনার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দামের প্রাক্কলন করেছে। তারা বলছে, স্বল্প মেয়াদে বা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম এক হাজার ৮০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে। মধ্য মেয়াদে বা ছয় মাসের মধ্যে মূল্যবান ধাতুটির দাম আউন্সপ্রতি এক হাজার ৯০০ ডলার হতে পারে। আর দীর্ঘ মেয়াদ বা এক বছরের মধ্যে প্রতি আউন্স সোনার দাম উঠতে পারে দুই হাজার ডলারে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত তিন কারণে বিশ্বজুড়ে সোনার দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। প্রথমত, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে করোনার রেকর্ড সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এতে দরপতন ঘটছে শেয়ারবাজারে। তাই অস্থির এ সময়ে ব্যবসায়ীরা নিরাপদ হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, ডলার দুর্বল হওয়ায় এটিও সোনার দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। তৃতীয়ত, অর্থনীতি সুরক্ষায় অনেক দেশ বিপুল অঙ্কের প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই সঙ্গে কমাচ্ছে সুদের হার। এর কারণেও সোনার দাম বাড়ছে। সিএনবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থনীতি রক্ষায় ব্যাপকভাবে প্রণোদনা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি সুদের হার নি¤œমুখী রাখছে। এতে এ বছর সোনার দাম ১৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার অস্থিরতার সময়ে সোনাকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করা হয়। এ্যাক্সিকর্পের প্রধান বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষক স্টেফেন ইনেস বলেন, ডলার দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি বাঁচাতে আরও প্রণোদনার দাবি তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সঙ্গত কারণেই সোনার দাম উর্ধমুখী থাকবে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ায় এই প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের সোনার বাজারে। অতীতে দেশের বাজারে সোনার দাম সাধারণত ভরিতে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা হ্রাস-বৃদ্ধি করা হতো। তবে এবার সবচেয়ে ভাল মানের সোনার দর (২২ ক্যারেট) এক লাফে পাঁচ হাজার ৭১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে জুয়েলার্স সমিতি। নতুন দর অনুযায়ী গত মঙ্গলবার থেকে প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ২২ ক্যারেট সোনা ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা বা প্রায় ৭০ হাজার টাকা, ২১ ক্যারেট ৬৬ হাজার ৭১৮ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৫৭ হাজার ৯৭০ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরি বিক্রি হচ্ছে ৪৭ হাজার ৬৪৭ টাকায়। এর আগে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা ৬৪ হাজার ১৫২ টাকা, ২১ ক্যারেট ৬১ হাজার ৮১৯ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৫৬ হাজার ৮০৪ টাকায় এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার ৩১ টাকায়। এর আগেও গত ২৮ মে দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল এক হাজার ৭১৯ ইউএস ডলার। জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগরওয়ালা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজারে এর আগে কখনই এত বেশি দামে সোনা বিক্রি হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে সোনার দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও তাদের দাম বাড়াতে হয়েছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, বিশ্ব বাজারে প্রতি ভরি গোল্ডের দাম ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। আমরা সেখানে ৫ হাজার ৭১৫ বাড়িয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে এখন অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি তাতে আমাদের ক্রেতা কমে গেছে ৮২ থেকে ৮৩ শতাংশ। আগামী দিনগুলোতে এই ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ ক্রেতাও পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে। এটি ১০ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে ধারণা করছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও দাম বেশি থাকলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্রেতা কমে আসবে।’ তবে আমদানি পুরোদমে শুরু হলে এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো চলা শুরু করলে সোনার সরবরাহ বাড়বে। তখন দাম কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখন দেশের বাইরে থেকে লোকজন আসা-যাওয়া কমে যাওয়ায় তারা যে সোনা আনত তা আসছে না। তার ওপর আমদানিও হচ্ছে না। যারা লাইসেন্স নিয়েছেন তারা আমদানি শুরু করলে সরবরাহ বাড়বে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি এনামুল হক খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আপাতত সোনার দাম কমার সম্ভাবনা নেই।’ তবে যতটুকু ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে তা আমদানি উৎসাহিত করতে যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন। কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নিম্নবিত্তরা তো আগে থেকেই সোনা কেনা বাদ দিয়েছেন। এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে চলে গেল এ ধাতব মুদ্রা। জানা যায়, দেশে ১৮ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেলেও গত ৬ মাসে মাত্র ১টি কোম্পানি সোনা আমদানিতে এলসি খুলেছে। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে সোনা আমদানির ওপর শুল্ক ছাড় দেয়া হয় ভরিতে এক হাজার টাকা। এ ছাড়া বছরে তিনবার ব্যাগেজ রুলের আওতায় ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি পর্যন্ত সোনা আনার সুযোগও দেয়া হয়। এ জন্য প্রতি ভরির জন্য দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আগে স্বর্ণবার আমদানিতে তিন হাজার টাকা শুল্ক দিতে হতো। এখন ২০ ভরি সোনার বার আনতে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে যোগ করা হয় আরও একটি বড় সুবিধা। চলতি অর্থবছরের শুল্ক সুবিধার সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য সোনার আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পুরোটাই প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। দেশে আমদানিকে উৎসাহিত করতেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে। এতে ভরিতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আমদানি খরচ কমবে বলেও মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এত সুবিধার পরও সোনা আমদানিতে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের। অথচ দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এর বড় অংশ বিদেশফেরত বাংলাদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন তারা। কিছুটা আমদানি করে এবং বাকিটা পুরনো সোনা গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা তাদের সোনার কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। আবার জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা সোনা আমদানি করেন না। কিন্তু প্রতিবছরই শত শত বার অবৈধ সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই প্রবণতা ঠেকাতে ও বৈধ পথে সোনা আমদানি করতে ২০১৮ সালে সোনা আমদানি নীতিমালা চূড়ান্ত করে সরকার। নতুন বাজেটে সোনা আমদানির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ কমানোয় তার প্রভাবে স্থানীয় বাজারে দাম খুব বাড়বে না বলে মনে করছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী আগরওয়ালা। তিনি বলেন, ‘এতদিন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সোনা আমদানি হতো না। নীতিমালার মাধ্যমে সোনা আমদানির সুযোগ দেয়া হলেও ভ্যাট বেশি হওয়ার কারণে কেউ আমদানি করতে আগ্রহ দেখায়নি। এবারের বাজেটে ভ্যাট কমানোয় অনেকেই আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন।’
×