ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৮০ ভাগ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় এরা যথাযথ চিকিৎসা ও পরামর্শ পান না

বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২৬ জুন ২০২০

বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে

নিখিল মানখিন ॥ বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। মোট চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর ৮০ শতাংশের বেশি বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। গত ১১ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ১৫ দিনে করোনায় মারা যাওয়া ৫৮২ জনের মধ্যে ১৫৪ জনই বাসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীরা যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ পান না। রোগীর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা না হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ চিকিৎসা প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কেউ খবর রাখেন না। অনেক সময় রোগীদের অনেকে নিজেদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি বা অবনতির বিষয়টি ধরতে পারেন না। আর বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা ও করোনা মিলে হঠাৎ করে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ার বিষয়েও ধারণা থাকে না অনেক রোগীর। ফলে হঠাৎ করে দুর্ঘটনা ঘটলে করার কিছুই থাকে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সরকারীভাবে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর সঙ্কুলান হচ্ছে না। সরকারী বেসরকারী সকল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনাটি ঘোষণা দেয়ার মধ্যেই রয়ে গেছে। অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল সেই নির্দেশনা মানছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে করোনা রোগীদের মধ্যে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা গ্রহণে আতঙ্ক ও অনীহা সৃষ্টি হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ফলে মোট আক্রান্তের ৮০ শতাংশের বেশি করোনা রোগী নিজেদের বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, দেশে প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে গত মে মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। ফলে জুনের প্রথমদিকে এসে করোনা থেকে মুক্ত হওয়া বিপুলসংখ্যক করোনা রোগীর সংখ্যা একসঙ্গে হঠাৎ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ঘোষণা দিতে হয়। এর আগে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে মারা যাওয়ার সংখ্যাও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিনে ঘোষণা দেয়া হয়নি। বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের নিয়মিত মনিটরিং না করার কারণেই এমনটি হয়েছে। এভাবে সঠিক পরামর্শ ও চিকিৎসার অভাবে বাসায় চিকিৎসাধীন অনেক করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজস্টি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা পরীক্ষার পর যদি পজিটিভ রেজাল্ট আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে। এবং যার পজিটিভ তার সংস্পর্শে যারা আসবে তাদের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যেতে হবে। যাদের শরীরে শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য লক্ষণ থাকবে তাদের অবশ্যই হাসপাতালে পাঠাতে হবে। যদি শারীরিক সমস্যা সামান্যতম থাকে তবেই তিনি বাসায় থাকবেন। যারা বাসায় মারা যাচ্ছেন তারা সঠিক চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাচ্ছেন। হয়ত তারা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাসায় অবস্থান করছেন। বাড়িতে নানান জনের নানান পরামর্শে এটা ওটা খাওয়াতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের দুর্বলতা। কেন রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না? প্রয়োজন হলে অবশ্যই তারা হাসপাতালে ভর্তি হবেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ বেনজির আহমেদ বলেন, করোনা রোগীর পাশাপাশি নন করোনা রোগীও বাড়ছে। যাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাই অনেকেই বাসায় মারা যাচ্ছেন। নন করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি প্রসারিত করা না যায় তবে এমনটা হবে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেই বেশি সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা হয়। কিন্তু এখন প্রাইভেট হাসপাতালে নন করোনা রোগীরাও সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। আর করোনা রোগীরাও হাসপাতালে বেড পাচ্ছেন না। আইসিইউ পাচ্ছেন না। তাই অনেকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। যাতে করে লোকজন সহজেই চিকিৎসা পেতে পারেন। পাশপাশি প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে অতিদ্রুত সক্রিয় করতে হবে। এবং আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা জনসহায়ক হতে হবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডাঃ মোস্তাক হোসেন বলেন, কিছু রোগী হয়ত হাসপাতালে যেতে চাননি বা যাননি। তারা মনে করেছেন বাসায় থাকলে ভাল হবেন। তাদের হয়ত সেই সক্ষমতা ছিল। আর কিছু রোগী হয়ত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। ভর্তি হতে না পেরে হয়ত বাসায় ফেরত গেছেন। যারা বাসায় ছিলেন তাদের শারীরিক অবস্থার হয়ত দ্রুত অবনতি হয়েছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি। যারা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা বাসায় থাকলেও একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। না হলে তারা বুঝতে পারবেন না অবস্থার অবনতি হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের করোনা আক্রান্ত বা নন করোনা সকল রোগীর দায়দায়িত্ব সরকারের। মহামারীর সময় প্রত্যেকটা রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখেন। কেউ যদি হাসপাতালে না আসেন তবে সরকারকে কোন না কোন চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হবে। হাসপাতালে আসলে সরকার নিজেই দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমদিকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আইইডিসিআর করেছিল। কিন্তু পরীক্ষার চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিদফতর পরীক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। সেটি ভালভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, রোগীকে ফলোআপ করার জন্য চিকিৎসক ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের ছিল তারা সেটি করেনি। তারা শুধু কারও সমস্যা হলে টেলিফোনে পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু একজন প্রান্তিক পর্যায়ের লোকের ক্ষেত্রে সেটি হয়ে উঠেনি। এখন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। তাই জেলায় হলে রোগীকে ফলোআপ করার জন্য সিভিল সার্জনের সঙ্গে, উপজেলায় হলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে। তারা প্রতিনিয়ত রোগীদের ফলোআপ করবেন তাহলে মৃত্যু সংখ্যা কমানো যাবে। ইতোমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের একটি অংশকে হয়ত বাঁচানো যেত। অন্যান্য করোনা আক্রান্ত দেশের তুলনায় আমাদের মৃত্যু কম। সেটাকে আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। যদি আমরা সবাই আরও ভালভাবে দায়িত্ব নেই।
×