ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্য এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় বাজেট বাস্তবায়ন শুরু ১ জুলাই পুরোদমে বাণিজ্যিক কর্মকা- শুরু করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা

সচল হচ্ছে অর্থনীতি ॥ করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ২৬ জুন ২০২০

সচল হচ্ছে অর্থনীতি ॥ করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

এম শাহজাহান ॥ করোনা সঙ্কটের মতো চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-। রেকর্ড রিজার্ভ ও ইতিবাচক রফতানি ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট বাস্তবায়নের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী ১ জুলাই থেকে। মরণঘাতী ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা ও উদ্বেগ থাকলেও উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কর্মকা- শুরু করে দিয়েছেন। রোজার ঈদের পর সারাদেশের দোকানপাট খুলে দেয়া হয়েছে। পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতি। এদিকে জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে কাজে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মার্কেট, শপিংমল, বিপণিবিতান, শোরুম ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে বেচাকেনা বেড়েছে। সরকারী-বেসরকারী সব ধরনের অফিসে কাজকর্ম শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক ও সচেতন নাগরিক সমাজ। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদির ব্যবহার বেড়েছে অনেক, কারণ সবাই সুস্থ থেকে বাঁচতে চান। মাস্ক, স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশ এখন সহজলভ্য পণ্যের নাম। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ২০২০-২১ অর্থবছর শুরু হতে যাচ্ছে। এর আগের দিন ৩০ জুন মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় বাজেট পাস হবে। এ বছর রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নের ঘোষণা ছিল সরকারের। কিন্তু করোনার কারণে সব হিসাব-নিকাশ উল্টে গেছে। করোনা থেকে জীবন বাঁচানো এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এখন সবচেয়ে বেশি জরুরী হিসেবে নিয়েছে সরকার। এ কারণে লকডাউন শিথিল করে সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। করোনা ভীতির মধ্যেই অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এছাড়া রেকর্ড রিজার্ভ, তৈরি পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক ধারা বজায় এবং অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় নতুন অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনা সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে জীবন বাঁচানোর জন্য। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হবে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। তিনি বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলা করে সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক হচ্ছে ॥ সীমিত আকারে লকডাউন তুলে নেয়ার পর মে মাস থেকে দেশে অর্থ-বাণিজ্যের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিশেষ বিশেষ স্থানে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন দেয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় সবাই নিজ উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। করোনা সঙ্কট মোকাবেলা করে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। সম্প্রতি এই টাস্কফোর্স একটি সভা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই বৈঠকে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে লকডাউন শিথিল করে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ফিরে গেছে। এদিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ওই সময় দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে দরিদ্র মানুষ। এছাড়া সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে এখন অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতরা সবাই কাজ করছেন এবং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করছেন। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এ সময় সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছেন। ব্যাংকাররাও কাজ করছেন। অনেক মানুষ ব্যাংকে যাচ্ছেন এবং নিয়মিত লেনদেন করছেন। একইভাবে রাষ্ট্রের জরুরী বিভাগের লোকজনও কাজ করছেন। তৈরি পোশাক ও ওষুধ কারখানার লোকজন কাজ করছেন এবং ওষুধ উৎপাদন করছেন। কৃষকরা এবার দলবেঁধে ধান কেটেছেন এবং শত শত মানুষ এক সঙ্গে হাওড়ের ধান কেটেছেন। গণমাধ্যম কর্মীরা সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখন সর্বত্র কাজকর্ম হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা সঙ্কট উত্তরণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। করোনা সামনে রেখেই এখন দেশের সব সেক্টরে কাজকর্ম করা হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এ কারণে বাজারে সরবরাহ চেইন ঠিক আছে এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ হচ্ছে, সময়মতো শিপমেন্টের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে, কোন সমস্যা হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, করোনার ক্ষতি মোকাবেলা ও তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। জীবন বাঁচানো ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট ॥ করোনার মতো চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে চলতি মাসের ১১ জুন মহান সংসদে জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে করোনা মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শুধু করোনার জন্য থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আরও ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে করোনা চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের জন্য ২৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সবমিলিয়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতে নতুন অর্থবছরে ব্যয় হবে ৫১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার একটি বড় অংশ দিচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো। তবে এবারের বাজেট বড় হলেও কর ও ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। জনগণকে স্বস্তি দিতে নতুন করে করারোপ করা হয়নি। এজন্য অবশ্য সরকারকে ঋণ নির্ভরতার দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোর ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাওয়ায় বাজেট বাস্তবায়নও সহজ হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এবারের বাজেট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা প্রশংসনীয়। এবারের বাজেটে আবেগ আছে, এখন বাস্তবায়ন সবচেয়ে বেশি জরুরী। তিনি বলেন, করোনা থেকে মানুষের জীবন আগে বাঁচাতে হবে। জীবন টিকে থাকলে অর্থনীতিও বাঁচবে। এছাড়া কোভিড-১৯ মোকাবেলা ও অর্থনেতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রস্তাবিত বাজেটেও বিষয়টির বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। কাঁচামালের অভাবে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার উৎপাদন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। তবে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কোন শিল্পে কাঁচামালের কোন সঙ্কট নেই। শিল্পকারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাক খাতের এ্যাক্সেসরিজ, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাট সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া ও কুঁচে এবং প্লাস্টিক শিল্পসহ মোট ১৩ খাতের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে লকডাউনের কারণে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হয় ২০০ কোটি টাকা। শিল্প খাতে দিনে ক্ষতি ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবা খাতে লকডাউনের সময় দিনে ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে করোনার অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী খাতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে এই টাস্কফোর্স। এছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে টাস্কফোর্স সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
×