ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবহমান বাংলার বর্ষা

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২৫ জুন ২০২০

আবহমান বাংলার বর্ষা

এসেছে বর্ষা। প্রকৃতির খিটখিটে অঙ্গে সতেজ ভাব ফুটিয়ে তুলতেই বর্ষার আগমন। গ্রীষ্মের তপ্ত তেজস্ক্রিয়তাকে বিদায় দিয়ে বঙ্গবক্ষে স্বরূপে পা ফেলেছে সে। রুক্ষ প্রকৃতির ব্যাকুলিত বুক থেকে ধুলোময় আস্তরণ সরিয়ে সজীবতা ফিরিয়ে আনে স্যাঁতসেঁতে এই শীতল ঋতু। গ্রীষ্মের ঘাম ও উষ্ণতায় অনুষ্ণ পরশ বোলাতে তার জুড়ি নেই। দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠকে সুজলা-সুফলা করতে সর্বত্র ডানা মেলে বর্ষার বৃষ্টিবিধৌত জল। পথঘাট তলিয়ে বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বর্ষা। বাংলার প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করে একেকটি ঋতু। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও আলাদা বৈশিষ্ট্য চরিত্রে ধারণ করে থৈথৈ পানিতে সাঁতার কাটে বর্ষা। তখন কালো মেঘে নীল হারায় আকাশ। এ সময় গগন ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরে অবিরত। তবুও মেঘ সরিয়ে স্বরূপে ফেরার কোন সামর্থই দেখাতে পারে না কৃষ্ণাঙ্গ আকাশ। মেঘবৃষ্টির দাপটে বর্ষা হয়ে ওঠে আরও সমৃদ্ধশালী। রিনিঝিনি মধুর মূর্ছনায় মেতে ওঠে সকাল, দুপুর, গোধূলি, রাত। অবিরাম বর্ষণে স্নাত করে তরুলতা বৃক্ষরাজি। ভারি বৃষ্টির পতন ধারায় গা ভিজিয়ে পরম তৃপ্তি অনুভব করে সকল পক্ষী প্রজাতি এবং বর্ষায় ফোটা কত বাহারি ফুল। বানের পানিতে পাপড়ি ছিটিয়ে পাতার ফাঁকে নিশব্দ হেসে চলে ন্যাড়া কদম্ব। গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকে বৃষ্টিক্লান্ত গোলাকার তমাল। বাদল দিনে জুবুথবু হিজলের আলতাবর্ণ পুষ্পমালা নতুন জলে ভাসতে ভাসতে ছুটে চলে বর্ষার ঘাটে ঘাটে। বর্ষা অভিলাষ পূর্ণ করতে বৃক্ষতলে ঝাঁপ দিয়ে সানন্দে ভেসে ওঠে অগণ্য গোলাকার ম্যাড়া গুটি। অঝোরে ঝরা বৃষ্টিবিন্দু অঙ্গে জড়িয়ে দল বেঁধে দিশাহীন খুশিতে মত্ত হয় শুকনো মৌসুমে সীমানাবন্দী কচুরিপানা। এ রকম কত শত অনুষঙ্গ নিয়ে বাংলার জমিনে হাজির হয় অপরূপ বর্ষা। গ্রীষ্মের পরেই বর্ষার অবস্থান। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাসের মিলিত রূপ বর্ষা। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষায় ভর করে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতি ব্যতিক্রমী রূপ ধারণ করে। রাস্তাঘাট ও মাঠ-ময়দান তলিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে আসে চারপাশ। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বর্ষা উতলা পানিতে অনেকটা ঘরবন্দী হয়ে পড়ে গ্রামবাংলা। এ সময়ে বৃষ্টির অবিরাম ঘন সারি গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে প্রাণ সঞ্চারিত করে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসা প্রকৃতির শুষ্ক সব উপাদান বর্ষা পরশে ফিরে পায় সতেজ হওয়ার পূর্ণ শক্তি। বর্ষা মৃত্তিকার কোলে ফিরিয়ে আনে উর্বরতা। এছাড়া অন্য ঋতুর শ্রীবৃদ্ধিতে বর্ষার ভূমিকা নিরহঙ্কারী বটবৃক্ষের মতো পরোপকৃতশীল। বসন্তকে বলা হয় ঋতুর রাজা। শরৎ তার রানী। আর বর্ষা, রানী শরতের অঙ্গে ঢেউ তোলা রিমিঝিমি নূপুর ধ্বনি। যে ধ্বনিতে উন্মাদ হয়ে ঋতুরাজ মিশে যায় বর্ষাবাদ্যে অহংকারী শরতে। অর্থাৎ, বর্ষার সুমধুর রাগিনী রানী শরতে বিদ্যমান। তাই বলা যেতেই পারে, রাজা বসন্ত ও রানী শরৎ দু’জনেই বর্ষার মুগ্ধ শ্রোতা। বৃষ্টিবাদলে বহুরূপী বর্ষা যেন অপূর্ব মেলবন্ধনের বহির্প্রকাশ। ষড়ঋতুর একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষাই বাজিয়ে যায় অবিরাম বাজনা। বর্ষার ঝমঝম বৃষ্টি ধ্বনি সুরের সেতারে তুলে অঙ্গুলিহীন মধুর গায়কী তাল। এই দিনে প্রেমধ্যানে মগ্ন প্রেমিক শুনতে পায় প্রেয়সীর পদলঙ্কার নূপুরের হৃদয়গ্রাহী আওয়াজ। বৃষ্টিভেজা অথৈ পানির বিস্তীর্ণ বুকে ঝাপটে পড়ে দূরন্ত কিশোরও মেতে ওঠে দুষ্টুমিতে। বৃষ্টির রুমঝুম তালে নকশি কাঁথায় সুঁই ঠেলে মনের সুপ্ত আলপনাতে নিজেকে ভাসায় ঘরবন্দী নারী বধূটি। বৃষ্টির তালে অবসরগ্রস্ত অন্যরা খেলে ষোলোগুঁটি, সাপলুডু ও কড়ি খেইল। বর্ষার এই অহঙ্কারী অবসর আনন্দ অন্য কোন ঋতু দিতে পারে না। এক কথায় অভিভূত হওয়ার অন্য নাম বর্ষা। প্রিয় বর্ষার রিনিঝিনি রূপ দর্শনে বরাবরই মোহিত হয়েছেন কবি-সাহিত্যিকেরা। ঋতুরাজ বসন্তকে নিয়ে তাদের ভাবনা যতখানি বিকশিত হয়েছে বর্ষাও তার থেকে কোন অংশে কম নয়। বৃষ্টিস্নাত জলমগ্ন বর্ষার শ্রীরূপ দর্শনে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গল্প, গান। বর্ষা ভাবুকেরা বর্ষার মাঝে অপার সৌন্দর্যের মন মোহনীয় লীলা খুঁজে পেয়েছেন। কখনও বর্ষাকে আহ্বান করে লেখা হয়েছে গান, কখনও কবিতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে টাপুরটুপুর বর্ষার কথা। আবার কখনও বর্ষা-বাদলকে প্রেমিক-প্রেমিকা আখ্যায়িত করে লেখা হয়েছে রসবোধক প্রেমের গল্প। সবকিছু মিলে বর্ষা যেন জয় করেছে কবি-সাহিত্যিকের লিখিয়ে মন। তাই তো বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রিয়জনকে আহ্বান করেছেন এই বর্ষায়। বর্ষামোহিত এই সাহিত্য প্রেমিক কবিতা-গানে বলেছেন- ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বর্ষায়। এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে, জল ভরা দৃষ্টিতে, এসো কোমল শ্যামল ছায়।’ বর্ষার বৃষ্টিবদ্ধ নিভৃত সময়ে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকুতিই জানান দেয় তার কাছে বর্ষা কতখানি প্রিয়। অন্যদিকে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় বর্ষা বন্দনা করেছেন এমন করে, ‘সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি/ চলিতে চলিতে চমকি’ উঠ না কবরী উঠে না দুলি!/সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল,/ তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!’ প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল হয়তো বর্ষারানীকে প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করে বলতে চেয়েছেনÑ তুমি কোথাও গেলে পায়ের শ্রুতিমধুর অলঙ্কারটুকু খুলে যেও। যেন তোমার চলে যাওয়ায় কেউ চমকে না ওঠে। হয়তো তোমার অপেক্ষায় এইখানে বসে কাঁদবে কেউ স্বচ্ছ জলে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর / উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর / রমণীর মন লয়ে / সুখে কেলি করে / দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।’ তার চিন্তা বলছেÑ বর্ষায় যেমন আনন্দ সজীবতায় জেগে ওঠে প্রকৃতি তেমনি মানুষও যুক্ত হয় সেই প্রমোদবিহারে। বর্ষার সৌন্দর্য অবলোকনে দেবতাগণ বসে থাকে না। তারাও অন্তরালে থেকে বর্ষার স্বরূপ দর্শন করে চলে। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান বর্ষাবাদল নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন- ‘হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে, / কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে।/ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে,/বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ঝরে।’ কবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে বর্ষার বর্ণনা করেছেন। বর্ষাদিনে কিভাবে কালোমেঘে ঢাকা থাকে আকাশ, আবার সেই মেঘ আকাশের বুক ছিদ্র করে কিভাবে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হয়ে পতিত হয় মাটিতে, সেই ঝর ঝর মনোহারী কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। কবি সুফিয়া কামাল হেমন্তের পাশাপাশি বর্ষাকেও কল্পনা করেছেন কবিতারূপে। তিনি গ্রীষ্মের তপ্ততা শেষে বর্ষার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছেনÑ ‘আমি বর্ষা, আসিলাম /গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি/মায়ার কাজল চোখে/মমতায় বর্মপুট ভরি।’ তিনি বর্ষাকে মায়ারূপী হিসেবে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের ব্যাকুলিত কথা প্রিয়জনকে বলতে বর্ষার ভীষণ মেঘাচ্ছন্ন মুহূর্তকেই বেছে নিয়েছেন। বলেছেনÑ ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরষায়।’ এ ছাড়া কবিগুরুর ভাবনায় বর্ষা যেন ভালো লাগা না লাগার এক উদাসীন কাল। এ মুহূর্তে কেন জানি মন ভালো নেই তার। তাই তিনি বৃষ্টিভরা ব্যগ্রচিত্তে বলেছেন, ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে জানিনে জানিনে / কিছুতে কেন যে মন লাগে না / ঝরঝর মুখর বাদল দিনে।’ বর্ষা নিয়ে কত কবিতা কত গান রচিত হয়েছে। তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্যের নানা দিক। তবে অতীতের বর্ষা ভাবনা বর্তমান ভাবনার সঙ্গে কিছুটা গরমিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখনকার বর্ষায় তার চিরচেনা রূপ নেই। এই তো গত দুই যুগ আগেও বর্ষা মানে ছিল অবিরাম বৃষ্টি। তখন সপ্তাহে একবার সূর্যের দেখা পায়নি প্রকৃতি ও মানুষ। কিন্তু বর্তমানে সে রকমটা নেই। এখন যে কোন সময় বৃষ্টি বাগড়ায় পড়তে পারে মানুষ। আবার যে কোন সময়ে বয়ে যেতে পারে প্রচ- তাপদাহ। প্রকৃতির এই পরিবর্তনের জন্য মানুষই অনেকাংশে দায়ী। মানুষের প্রকৃতিবৈরী আচরণে লুপ্ত হচ্ছে প্রতিটি ঋতুর বৈশিষ্ট্যগত দিক। বৃষ্টিস্নাত বর্ষাও এর বাইরে নয়। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×